আন্তর্জাতিক নারী আন্দোলনের ধারা


[এক]
মানব সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব ও তার ভিত্তিতে সমাজে শ্রেণীদ্বন্দ্ব ও শ্রেণীশোষণের সঙ্গে নারীজাতির বশ্যতা ও তাদের উপর শোষণ নিপীড়নের সম্বন্ধ ঐতিহাসিকভাবেই অবিচ্ছেদ্যরূপে জড়িত রয়েছে। তাই যতদিন পর্যন্ত সমাজে একশ্রেণীর দ্বারা আর এক শ্রেণীর শোষণের অবসান না ঘটে, ততদিন পর্যন্ত সামগ্রিকভাবে নারীর উপর পুরুষের প্রভুত্বের অবসান হতে পারে না, নারী-পুরুষের মধ্যে প্রকৃত সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় এক শ্রেণীর মানুষের দ্বারা আর একশ্রেণীর মানুষের উপর শোষণের অবসান হয়। তখন সমস্ত সাধারণ মানুষই সামাজিক উৎপাদনের ব্যবস্থাগুলির অধিকারী হয়। ব্যক্তিগত সম্পত্তি প্রথার বিলোপ সাধিত হয়। নারীপুরুষ নির্বিশেষে সকলেই সামাজিক উৎপাদনের কাজে অংশগ্রহণ করতে পারে। নারীপুরুষ নির্বিশেষে সমগ্র জনগণের বেকার অবস্থা দূর হবার সুযোগ খুলে যায়। তখন নারীরা ব্যাপকভাবে সামাজিক উৎপাদনের কাজে যোগ দিতে পারে বা তাদের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন সম্ভব হতে পারে। এই অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন ছাড়া নারীর পূর্ণ মুক্তি সম্ভব নয়। শ্রেণীবিভক্ত সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামোর আমূল পরিবর্তন ছাড়া নারীপুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্য কাজের সুযোগ মেলা সম্ভব নয়। সমাজতান্ত্রিক সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তি প্রথার বিলোপ হয়। সমাজতান্ত্রিক সমাজে মূলত শ্রেণীশোষণের অবসান ঘটে বলেই শোষিত নারী সমাজের পূর্ণ মুক্তি সম্ভব হয়। আর ঠিক এই কারণেই শোষিত সর্বহারা শ্রেণীর মুক্তির সঙ্গে শোষিত নারীজাতির মুক্তির প্রশ্নটি অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত থাকে।
নারীর পরাধীনতার মূলে আছে নারীকে সামাজিক উৎপাদনের কাজ থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে তাকে ঘরকন্নার কাজের মধ্যে আটকে রাখা এবং তাকে অর্থনৈতিকভাবে পরাধীন করে রাখা। ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, নারীর পরাধীনতার সূচনা হয়েছিল সমাজের জননীবিধির অবসানের সঙ্গে সঙ্গে এবং সেই পরাধীনতা সম্পূর্ণ হয় সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তির ভিত্তিতে শ্রেণীশোষণ, এক বিবাহ প্রথা, (যা কিনা তখন ছিল প্রকৃতপক্ষে শুধু নারীর জন্যই প্রযোজ্য কড়াকড়ি নিয়ম, আর পুরুষের বহু বিবাহ ও ব্যভিচারের পথ ছিল প্রশস্ত), এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির ভিত্তিতে ব্যক্তিগত পরিবার প্রথা প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে। তাই নারীর পরাধীন অবস্থা থেকে মুক্তিলাভের প্রথম কথাই হলো সমগ্র নারীসমাজকে আবার সামাজিক উৎপাদনের কাজের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দিতে হবে। এইটিই হলো নারীমুক্তির গোড়ার কথা।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইওরোপে ধনতন্ত্রের বিকাশ শুরু হয়, ইংলন্ডে শিল্প বিপ্লব সংঘটিত হয়। ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি প্রভৃতি বিভিন্ন দেশে বড় বড় কলকারখানা গড়ে ওঠে। গতানুগতিক সামন্ততান্ত্রিক সমাজকাঠামো ভেঙে যেতে থাকে। ধনতান্ত্রিক সমাজ গড়ে উঠতে থাকে। সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামোতে পরিবর্তন আসে। বড় বড় শিল্প নগরী গড়ে উঠতে থাকে। গ্রামের ভূমিকেন্দ্রিক সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতিতে ভাঙন ধরে। ওদিকে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে (১৭৮৯) ফরাসী বিপ্লবের প্রভাবে ইউরোপের দেশে দেশে আলোড়ন দেখা দেয়। রুশো, ভলটোয়ার প্রমুখের ‘সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার’ বাণী নবজাগরণের চিন্তাধারা বিস্তার করতে থাকে।
ব্যাপক শিল্প প্রসারের জন্য স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে কলকারখানায় ব্যাপকভাবে শ্রমিক নিয়োগ করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। পুঁজিবাদী উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্রমশক্তির প্রয়োজন হয়। কলকারখানায় তখন নারী ও শিশুদের নিয়োগ করা হতে থাকে। অবশ্য এর অন্যতম কারণ এই যে নারী ও শিশুদের কাজের জন্য পুরুষ শ্রমিকদের চেয়ে অনেক কম মজুরি দিলেই চলত। অথচ যন্ত্রের উন্নতি হওয়ার ফলে নারীরা শারীরিকভাবে পুরুষের চেয়ে দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও কাজের দিক থেকে কম দক্ষ ছিল না। এ বিষয়ে মার্কস-এঙ্গেলস ‘কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো’তে লিখেছেন: আধুনিক শিল্পের যতই উন্নতি হতে থাকল ততই নারীরা শ্রমের দিক থেকে পুরুষদের ছাড়িয়ে যেতে লাগল। শ্রমিকশ্রেণীর ক্ষেত্রে নারী পুরুষ বা শিশু শ্রমের যন্ত্র নারী পুরুষ বা শিশু হিসেবে তাদের মূল্য কম বেশি এই যা। [“The more modern industry becomes developed, the more is the labour of men superseded by that of women. Differences of age and sex have no longer any distinctive social validity for the working class. All are instruments of labour more or less expensive to use, according to their age and sex.”] (Communist Manifesto)
এইভাবে আধুনিক যুগে কলকারখানায় নারী শ্রমিকদের নিয়োগের মধ্য দিয়ে নারীসমাজের অবস্থার একটা পরিবর্তন এল। একদিক থেকে ধনতন্ত্রের যন্ত্রযুগের নতুন শোষণ ব্যবস্থায় শ্রমিক নারীদের উপর নেমে এল কঠিন শোষণ, নিপীড়ন, কিন্তু অন্যদিক থেকে এই ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থাই নারীসমাজের একাংশকে সামাজিক উৎপাদনের কাজের মধ্যে টেনে এনে তাদের সামাজিক মুক্তির পথ খুলে দিল। শ্রমিক নারীরা স্বাধীনভাবে উপার্জন করে স্বাবলম্বী হতে থাকল, অনেক ক্ষেত্রে সংসার চালাবার দায়িত্ব বহন করতে থাকল। অর্থাৎ পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় শ্রমিকশ্রেণীকে যখন নতুন নতুন পন্থায় শোষণ করা হতে থাকল, তখন একদিক থেকে নারীদের উপরও কঠিন শোষণ ব্যবস্থা চালু হলো, আর অন্যদিক থেকে সামাজিক উৎপাদনের কাজে যোগ দেবার মধ্য দিয়ে নারীসমাজের মুক্তির পথও খুলতে থাকল। যদিও নারীসমাজের মাত্র একাংশই এই স্বাধীন উপার্জনের কাজে যুক্ত হলো, তবুও তার মধ্য দিয়েই শোষিত নারীসমাজের সামাজিক মুক্তির সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেখা গেল।
ইংল্যান্ডের ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায় যে ভিক্টোরীয় যুগে সেখানে যেমন ব্যাপক শ্রমিকশ্রেণী গড়ে উঠল, তেমনি সেখানে ধনী মধ্যবিত্ত শ্রেণীও প্রতিষ্ঠিত হতে থাকল। তখন উচ্চ মহলের বা অভিজাত মহলের নারীদের মধ্যে শিক্ষা সংস্কৃতির চর্চার সুযোগও খুলে গেল। কিন্তু তাদের মধ্যে বেশির ভাগই ‘খেটে খাওয়া’ মেয়ে নয়। এইসব অভিজাত নারীরা বা লেডিজ শিল্পকলা, সাহিত্য চর্চা করতেন অবসর বিনোদনের জন্য। বুর্জোয়া নবজাগরণের প্রভাবে নারীদের ব্যক্তিত্ব বিকাশের ও তাদের মধ্যে শিক্ষা-সংস্কৃতি প্রসারের প্রয়োজনবোধও দেখা দেয়। এইভাবে উচ্চমহলের নারীদের মধ্যে শিক্ষা-সংস্কৃতি শিল্পকলা সাহিত্য জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা হতে থাকে। তাদের মধ্যে অনেকে ক্রমশ নবজাগরণের যুক্তিবাদ ও মানবতাবাদের আদর্শে পুরুষের সঙ্গে নারীদের সমানাধিকারের আন্দোলনে এগিয়ে আসে। মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত নারীদের মধ্যে অনেকে শিক্ষিকার কাজ, নার্সিং-এর কাজ, দর্জির কাজ, সূচিশিল্প, চিত্রকলা, অভিনয়, সাহিত্য, সাংবাদিকতা প্রভৃতি উপার্জনমূলক কাজে যোগ দিতে থাকে ও অর্থনৈতিক স্বাবলম্বনের পথে এগিয়ে যায়। আর নিচের তলার বা গ্রাম শহরে গরিব, দুঃস্থ, অশিক্ষিত নারীদের মধ্যে বেকারী দারুণভাবে দেখা দেয়। তাদেরই একটা বড় অংশ কলে-কারখানায় শ্রমিকের কাজে যোগ দেয়। এইভাবে নারীরা বিভিন্নভাবে অর্থকরী কাজে যোগ দেবার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো একটা নতুন অধ্যায়।
নারীরা উপার্জনের কাজে যোগ দেবার সঙ্গে সঙ্গে শ্রমজীবী মানুষদের মধ্যে নারী-পুরুষদের পারিবারিক সম্বন্ধেও পরিবর্তন দেখা দিতে থাকল। নারীরা অর্থনৈতিকভাবে নিজের পায়ে দাঁড়াতে থাকলে নারীর উপর পুরুষের প্রভুত্বের ভিত্তিই নড়ে গেল। যদিও যুগ-যুগান্তের অভ্যাস ও সংস্কারের বশে শ্রমিক পরিবারের মধ্যেও পুরুষের প্রাধান্য সহজে দূর হতে পারল না, কিন্তু তার মূল ভিত্তি নড়ে গেল ঠিকই এবং ভবিষ্যতে নারী-পুরুষের সম-মর্যাদা ও সমানাধিকারের পথ খুলে যেতে থাকল। এই প্রসঙ্গে এঙ্গেলস লিখছেন ....আরো দেখা গেল যে কলকারখানা, বৃহৎ শিল্প প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে নারীদের গৃহকর্মের গণ্ডী থেকে শ্রমের বাজারে ও কলে-কারখানায় এনে ফেলল এবং অনেক ক্ষেত্রে নারীদের উপরেই সংসারের জীবিকা উপার্জনের দায়িত্ব এসে গেল। তখন সর্বহারাদের পারিবারিক জীবনে নারীর উপর পুরুষের প্রভুত্বের শেষ চিহ্নটুকুও বজায় রাখবার আর ভিত্তি রইল না। [“....Moreover, since large scale industry has transferred the woman from the house to the labour market and the factory, and makes her, often enough, the bread winner of the family, the last remnants of male domination in the proletarian home have lost all foundations” - Engels: the Origin of the Family, Private Property and the State), বলা বাহুল্য, তবুও শ্রমজীবী নারীরা কিন্তু সমান কাজের জন্য পুরুষের সমান মজুরি পেল না, আর সামাজিক ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্যও রয়ে গেল। কারণ সমগ্র সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামোর আমূল পরিবর্তন হলো না বা শ্রেণীশোষণের অবসান হলো না। একপ্রকার শ্রেণীশোষণের থেকে আর একপ্রকার শ্রেণীশোষণই দেখা দিল মাত্র। সমাজের মধ্যে শ্রেণীদ্বন্দ্ব নতুনরূপে আরো তীব্র হলো।
এঙ্গেলস আগেই বলেছেন যে শ্রেণীবিভক্ত সমাজে এমন কোনো অগ্রসর ধাপ দেখা যায় না, যা কিনা আবার একটা নতুন সমস্যা বা একধাপ পশ্চাদপসরণের অবস্থার সৃষ্টি না করে। ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় কিছু সংখ্যক নারীর স্বাবলম্বনের পথ খুলে দিল বটে, আবার সঙ্গে সঙ্গে তাদের পারিবারিক জীবনও ভেঙে যেতে লাগল। তাদের গৃহজীবনে সন্তানপালন, ঘরকন্নার কাজ প্রভৃতির জন্য সরকার বা রাষ্ট্র থেকে তো আর কোনো ব্যবস্থা করা হলো না। শ্রমিক পরিবারের শিশুদের জীবনেও তাই নেমে এল চরম দুর্দশা। শ্রমিক পরিবারগুলির পারিবারিক জীবন ভেঙে পড়তে লাগল। আবার অন্যদিক থেকে অর্থনৈতিক দুরবস্থার চাপে অনেক সামাজিক সমস্যাও তীব্র হতে থাকল। ধনতন্ত্রের যুগে নারীর পতিতাবৃত্তিও অনেক ব্যাপকভাবে দেখা দিল। নারীদের মধ্যে পতিতাবৃত্তির ব্যাপক প্রসার হয়, যার পিছনে রয়েছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণ। ভিক্টোরীয় যুগের অভিজাত সংস্কৃতিবান ভদ্রলোকদের নৈতিক ধ্যান-ধারণা অনুযায়ী ও পারিবারিক জীবনের মানের নতুন বিশ্লেষণে পরিবারের মধ্যে রক্ষিতাদের সংখ্যা ক্রমশ কমে গেল বটে, কিন্তু সেই অনুপাতেই সামাজিক ক্ষেত্রে পতিতাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকল। ধনতান্ত্রিক শিল্প প্রসারের যুগে নারীদেরও পর্যন্ত পণ্যদ্রব্যে পরিণত করা হলো।
এইভাবেই ধনতন্ত্রের যুগে একদিক থেকে নারীদের মুক্তিপথের ইঙ্গিত দেখা দিল, অন্যদিক থেকে তাদের দুঃখ-দুর্দশা অবমাননাও চরমে পৌঁছল। সঙ্গে সঙ্গে সর্বহারা শ্রেণীর উপর শোষণ নিপীড়নের ও তাদের শ্রেণীসংগ্রামের বিষয়গুলির সঙ্গে নারীরাও প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হয়ে গেল।

[দুই]
এই সময় ঊনবিংশ শতাব্দীতে সর্বহারা শ্রেণীর মুক্তির পথ নির্দেশ করলো মার্কসবাদ। মার্কসবাদী তত্ত্ব ও বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে মার্কস-এঙ্গেলস তুলে ধরলেন সর্বহারা শ্রেণীর যুগান্তকারী বৈপ্লবিক ভূমিকা। তাঁরা দেখালেন যে ধনতন্ত্রের বিকাশের মধ্য দিয়ে যে শোষিত সর্বহারা শ্রেণীর সৃষ্টি হলো, তারাই পালন করবে সমস্ত শোষিত-নিপীড়িত মানুষের মুক্তি সংগ্রামে প্রধান ভূমিকা, তারাই রচনা করবে ধনতন্ত্রের সমাধি, তারাই প্রতিষ্ঠিত করবে শ্রেণীহীন, শোষণহীন নতুন সাম্যবাদী সমাজ। ১৮৪৮ খ্রীষ্টাব্দে মার্কস-এঙ্গেলস তাঁদের ‘কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো’র মধ্যে তুলে ধরলেন সর্বহারা শ্রেণীর সেই যুগান্তকারী ভূমিকা, পথ নির্দেশ করলেন বুর্জোয়াশ্রেণীর বিরুদ্ধে সর্বহারাশ্রেণীর রণনীতি ও কৌশলের। ফ্রান্স, জার্মানি এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশে বুর্জোয়া বিপ্লবের প্রাক্কালে ‘কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো’র প্রকাশ মানব সমাজের বিশ্ব ইতিহাসের নতুন দিগদর্শক রূপে দেখা দিল। ‘কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো’তে মার্কস-এঙ্গেলস দেখালেন যে শ্রেণীসংগ্রামের মধ্য দিয়ে সর্বহারা বিপ্লবের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হবে সর্বহারার একনায়কত্ব, প্রতিষ্ঠিত হবে শ্রেণীহীন শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজ, বিশ্বসমাজ এগিয়ে যাবে পূর্ণ সাম্যবাদ বা কমিউনিজমের দিকে। এই সত্য আবিষ্কার করে মার্কসবাদই সর্বপ্রথম সর্বস্তরের শোষিত মানুষের মুক্তিসংগ্রামের নেতৃত্বের ভূমিকায় সর্বহারাশ্রেণীর ঐতিহাসিক কাজ ও দায়িত্বের কথা তুলে ধরলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা দেখালেন যে এই সর্বহারাশ্রেণীর মুক্তির সঙ্গেই অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে শোষিত নারীসমাজের মুক্তির প্রশ্নটি এবং সর্বহারার শ্রেণীসংগ্রামের সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে চলেছে শোষিত নারী সমাজের মুক্তির সংগ্রাম। মার্কসবাদই সর্বপ্রথম সমাজে নারীজাতির পরাধীনতার অবস্থার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে যে ব্যক্তিগত সম্পত্তির উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত শ্রেণীবিভক্ত সমাজব্যবস্থাই হলো নারীজাতির পরাধীনতার মূল কারণ এবং একমাত্র শ্রেণী শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজেই অন্যান্য শোষিত জনগণের সঙ্গে সঙ্গে নারীসমাজেরও পূর্ণমুক্তি সম্ভব হতে পারে। সারা বিশ্বে নারীজাতির সমানাধিকার ও মুক্তি সংগ্রামের বিষয়ে আলোচনা এই শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই করা দরকার।
১৮৪৮ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত ‘কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো’তে পুঁজিবাদী সমাজে নারীজাতির উপর শোষণের চরম স্বরূপ উদঘাটন করে দেখানো হয় এবং দেখানো হয় যে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে সর্বহারাশ্রেণীই সর্বপ্রথম থেকে নারীমুক্তির জন্য সংগ্রাম করে আসছে। মেনিফেস্টোতে মার্কস-এঙ্গেলস বিশেষ করে শ্রেণী সমাজে পরিবার প্রথার বিশ্লেষণ করে দেখান যে বুর্জোয়ারা পুরুষ ও নারীর সম্পর্কের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে একটা পণ্যচরিত্র সৃষ্টি করেছে, সেখানে নারীর কোনো মর্যাদার আসনই নেই। বুর্জোয়ারা সামগ্রিকভাবে নারী সমাজকে একটা বশ্যতা ও দাসত্বের জালে আবদ্ধ করে রেখেছে, পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই তার জন্য মূলত দায়ী। তাই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে থেকে শোষিত নারী সমাজের সমানাধিকারের দাবি-দাওয়ার আন্দোলনে যতদূরই অগ্রসর হওয়া যাক না কেন, সে সাফল্য শুধু আংশিক ও সীমাবদ্ধভাবেই হতে পারে। কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো দেখিয়েছে যে পুঁজিবাদের অবসানের সঙ্গেই শোষিত সর্বহারা শ্রেণীর যেমন মুক্তি আসবে, শোষিত নারী সমাজেরও তেমনি মুক্তি আসবে।
১৮৪৫ খ্রীষ্টাব্দে এঙ্গেলস তাঁর ‘কনডিশন অব ওয়ার্কিং ক্লাস ইন ইংল্যান্ড’ (Condition of Working class in England: Engels) বইয়ে দেখিয়েছেন যে, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় কতদূর নিষ্ঠুরভাবে নারীশ্রমিক ও শিশু শ্রমিকদের শোষণ করা হয়। ১৮৬৭ সালে কার্ল মার্কস তাঁর ‘ক্যাপিটাল’ (Capital) গ্রন্থে বুর্জোয়া সমাজে নারী শ্রমিকদের উপর শোষণের অবস্থাকে বিশেষভাবে তুলে ধরেন। তারপর এঙ্গেলস তাঁর বিখ্যাত ‘পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’ (The Origin of the Family, Private Property and State: Engels) পুস্তকে শ্রেণীসমাজে নারীর উপর শোষণের অবস্থাটাকে ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন, এবং দেখান যে, নারীর মুক্তিলাভের প্রথম শর্ত হলো এই যে সমগ্র নারীসমাজকে আবার সামাজিক উৎপাদনের কাজের মধ্যে পুনঃপ্রবেশ করতে হবে।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নারী আন্দোলনের ইতিহাসের ধারা আলোচনা করতে গেলে আমরা দেখতে পাই যে উনবিংশ শতাব্দীর বুর্জোয়া নবজাগরণের সময় থেকেও আবার নবজাগরণের যুক্তিবাদ ও মানবতাবাদের আন্দোলনের মধ্যে নারীর ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য ও সমানাধিকারের প্রশ্নটিও সামনে আসে। তার মধ্য দিয়ে নারীদের একাংশের কিছু কিছু সীমাবদ্ধ সামাজিক অধিকারও মেলে, কিন্তু সে সব আন্দোলন ও সীমাবদ্ধ অধিকার কোনো মতেই সমগ্র শোষিত নারী সমাজের পূর্ণ মুক্তির কোনো পথই দেখায় না।
একমাত্র মার্কসবাদেই সর্বপ্রথম নারীর পরাধীনতার প্রশ্নটির বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করে সর্বহারার শ্রেণীসংগ্রামের সঙ্গে নারীর মুক্তি-সংগ্রামের প্রশ্নটিকে যুক্ত করে দেখানো হয় এবং আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের সূচনা থেকেই সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে নারী মুক্তি আন্দোলনেরও সূচনা হয়। আর তারই পাশাপাশি প্রগতিশীল বুর্জোয়া শ্রেণীর উদ্যোগেও নবজাগরণের মানবিকতাবাদ ও যুক্তিবাদের ভিত্তিতে সীমাবদ্ধ রূপেই নারীর সমানাধিকারের আন্দোলনও চলে আসছে। সমাজ বিবর্তনের ইতিহাসের মধ্য দিয়েই এই মার্কসবাদী তত্ত্বের সত্যতা প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, সমাজে শ্রেণীশোষণই নারীর পরাধীনতার মূল ভিত্তি এবং একমাত্র শ্রেণীহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজেই নারীর পূর্ণমুক্তি সম্ভব। তাই সোভিয়েত রাশিয়া, চীন প্রভৃতি সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে নারীসমাজের প্রকৃত পূর্ণমুক্তির সাধিত হয়েছে। তারা অনেকাংশে পুরুষের সমান অধিকার ভোগ করতে পারছে। আর তারই পাশাপাশি ধনতান্ত্রিক-সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার দেশগুলিতে, এমনকি আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স প্রভৃতি উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশগুলিতেও নারী-পুরুষের প্রকৃত সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। কারণ, শ্রেণীবিভক্ত সমাজে সর্বহারাশ্রেণীর সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য অংশের শোষিত জনগণের সঙ্গে নারীসমাজের উপরও শোষণ-নিপীড়ন বজায় থাকবেই।
আন্তর্জাতিক নারী আন্দোলনের ধারা কিভাবে এগিয়ে চলেছে, সে বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে শোষিত নারীসমাজের মুক্তির প্রশ্নটিকে এই শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখতে হবে। তা হলেই আমরা বিভিন্ন ধরনের আন্তর্জাতিক নারী আন্দোলনের ধরনটি বুঝতে পারব এবং সর্বহারাশ্রেণীর ও অন্যান্য শ্রেণীর নেতৃত্বে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে যে নারী আন্দোলন হয়ে আসছে তার প্রকৃত তাৎপর্য বুঝতে পারব।
১৮৬৪ সালে শ্রমিকশ্রেণীর ‘প্রথম আন্তর্জাতিক সংগঠনে’ (International Workingmen’s Association) গঠনের সময় থেকেই কার্ল মার্কস কার্যক্ষেত্রে নারীর অধিকারের প্রশ্নটি তুলে ধরেন। তাঁর সময়ে কিছু কিছু সমাজতান্ত্রিক ও
সংস্কারবাদীরা প্রস্তাব করলেন যে কলকারখানায় নারীদের কাজ করা নৈতিক দিক থেকে অবমাননাকর, সুতরাং নারীদের বাইরের কাজ না করে ঘরের কাজের মধ্যে থাকাই ভাল। প্রুধোঁনিস্টদের মতবাদ ছিল এইরকম। কিন্তু মার্কস সাধারণ কাউন্সিলের সভ্য হিসাবে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করলেন এবং কল-কারখানায় নারী ও শিশুদের কাজের ক্ষেত্রে, বিশেষভাবে রাত্রের কাজ ও যে কাজ শারীরিক ও নৈতিকভাবে নারী ও শিশুদের পক্ষে ক্ষতিকারক, সেই সম্পর্কে আইন প্রণয়ন করার প্রস্তাব করলেন। মার্কস বোঝালেন যে কলকারখানার কাজ থেকে নারীদের সরিয়ে দেওয়া নয়, তারা যাতে উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা পেয়ে সসম্মানে কাজ করতে পারে তার ব্যবস্থা করাই দরকার। প্রথম আন্তর্জাতিকের নীতি অনুযায়ী ট্রেড ইউনিয়নগুলিতে সর্বপ্রথম পুরুষের সঙ্গে সঙ্গে নারী শ্রমিকদেরও সভ্য করা হতে থাকে এবং পুরুষ ও নারী শ্রমিকদের সমান অধিকারের দাবি ঘোষণা করা হয়। এই সময়ে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, জার্মানি প্রভৃতি দেশে নারী শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ হতে থাকে। লায়ন্স-এর রেশম কারখানায় আট হাজার নারী শ্রমিক স্ট্রাইক ঘোষণা করে ‘প্রথম আন্তর্জাতিক’-এর সঙ্গে যোগদান করে পুরুষ শ্রমিকদের সঙ্গে আন্দোলন সংগঠিত করে। জার্মানির সুতাকলের নারী শ্রমিকরা সর্বহারা নারী শ্রমিকদের আন্দোলনের পুরোভাগে এগিয়ে আসে।
১৮৭১ সালে প্যারী বিপ্লবের সময় শ্রমজীবী নারীদের সংগ্রামী ভূমিকা ঐতিহাসিক এবং অবিস্মরণীয়। সে সময় প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্যে এগিয়ে এসেছিলেন কারখানার নারীশ্রমিক থেকে শুরু করে চারুশিল্পী, কারুশিল্পী, সীবনশিল্পী, দর্জি, সেলুনকর্মী, লন্ড্রিকর্মী, হোটেলের কর্মী, ঠিকে মজুর প্রভৃতি সমস্ত স্তরের নারী শ্রমিক এবং সঙ্গে সঙ্গে মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী নারী কর্মীরাও। সর্বস্তরের শ্রমজীবী নারীরা দলে দলে এই বিপ্লবের কাজে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং বহু নারী প্রবল বীরত্বের সঙ্গে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। ইতিহাসে দেখা যায় যে তখনকার ‘যুদ্ধ পরিষদ’-এর কাছে অভিযুক্ত করা হয়েছিল ১০৫১ জন নারীকে।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে (১৭৮৯) ফরাসী বিপ্লবের উদাত্ত মানবিক আবেদন সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার বাণী সমাজের সর্বস্তরের স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষের মনে সাড়া জাগিয়েছিল। ফরাসী নারীরা অভূতপূর্ব বীরত্বের সঙ্গে পুরুষদের পাশাপাশি সংগ্রাম করেছিলেন মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য। ১৭৯৩ সালে ‘মানুষের অধিকার’-এর ঘোষণাপত্র যখন পড়া হয় তখন ওল্যাম্ন দ্য গুৎজ নামক একজন ফরাসী নারী বলেছিলেন: “নারীদের যদি ফাঁসিকাষ্ঠে যাবার অধিকার থাকে, তবে পার্লামন্টেই বা তাদের অধিকার থাকবে না কেন?” সেই বৎসরই ওল্যাম্ন দ্য গুৎজ-এর ফাঁসি হয়েছিল। নারীদের মধ্যে সমাজ চেতনার স্ফুরণের এইরকম অনেক বিচ্ছিন্ন উদাহরণ পাওয়া যায়।
ফরাসী বিপ্লবের গৌরবময় ঐতিহ্য বহন করে প্যারী বিপ্লবে নারীরা ব্যাপকভাবেই অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের উল্লেখ করে মার্কস লিখেছেন “প্রকৃত প্যারী রমণীগণ প্রাচীনকালের নারীদের মতই মহৎ একনিষ্ঠরূপে পুরোভাগে এগিয়ে এসেছেন, প্যারীর নারীগণ ব্যারিকেড ও বধ্যভূমিতে প্রফুল্ল মনে জীবন বিসর্জন দিয়েছেন।” [“The real Parisian women come to the surface, nobel and devoted like the women of Antiquity. The women of Paris joyfully gave up their lives on the barricade and execution ground.”]
প্যারী বিপ্লবের বহুপূর্ব থেকেই ফরাসী দেশের শ্রমজীবী নারীদের নারী মুক্তি আন্দোলন চলে আসছিল বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে। ‘কমিউন’-এর মধ্যেও সৈনিক নার্স প্রভৃতি বিভিন্ন কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে বহু নারী। প্যারী বিপ্লবের মধ্যে যে অগণিত সাধারণ নারী কর্মী পুরুষদের পাশে থেকে জীবন বিসর্জন দিয়েছেন তাদের সকলের নাম ইতিহাসে লেখা নেই, কিন্তু শোষিত নারীসমাজের মুক্তি আন্দোলনের ইতিহাসে তাঁদের অবদান ঐতিহাসিক। তাঁদের মধ্যে অন্যতম নেত্রী লুই মিচেলের নাম ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। তাঁকে দ্বীপান্তর দণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
প্যারী বিপ্লবের সময়ই সর্বপ্রথম ব্যাপকভাবে শ্রমজীবী নারীরা সংগঠিতভাবে রাজনৈতিক আন্দোলনের কাজে অংশগ্রহণ করে। শ্রমজীবী নারীদের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক চেতনা ও ভাবধারা এইসময় থেকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ‘কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক’-এর কর্মসূচী রূপায়ণের কাজে বিভিন্ন দেশে শ্রমজীবী নারীরা এগিয়ে আসতে থাকে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলন ও সর্বহারা শ্রেণীর মুক্তির বৈপ্লবিক আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দেশে শ্রমজীবী নারীদের অধিকার ও দাবি-দাওয়ার জন্য কাজ শুরু হয়। ১৮৮৯ খ্রীষ্টাব্দে প্যারী শহরে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে বিশ্ববরেণ্য কমিউনিস্ট নেত্রী ক্লারা জেটকিন সর্বপ্রথম সর্বক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের দাবি জানিয়ে একটি স্মরণীয় বক্তৃতা দেন। এই বক্তৃতা পৃথিবীর দেশে দেশে বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করে, তার কারণ এর আগে আর কোনো আন্তর্জাতিক সম্মেলনের মঞ্চ থেকে নারীর সমানাধিকারের দাবি ঘোষণা করা হয়নি। ইতিপূর্বে বিভিন্ন দেশে নারী শ্রমিকদের দাবি-দাওয়ার উপর বিচ্ছিন্নভাবে আন্দোলন হয়েছে। ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দে মার্চ মাসে নিউইয়র্কের দর্জি কারখানায় নারী শ্রমিকদের উপযুক্ত বেতন ও দশ ঘন্টা কাজের দাবিতে একটি উল্লেখযোগ্য শোভাযাত্রা হয়। প্যারী শহরে উক্ত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনের পর ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্রান্স, জার্মানি প্রভৃতি শিল্পোন্নত দেশে নারী শ্রমিকদের মধ্যে আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। তারপর ১৯০৭ খ্রীষ্টাব্দে জার্মানির স্টাটগার্টে প্রথম আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ক্লারা জেটকিন এই নবগঠিত সংগঠনের সাধারণ সম্পাদিকা নির্বাচিত হন। ১৯০৮ সালের ৮ মার্চ নিউইয়র্কের দর্জি মেয়েদের ঐতিহাসিক ভোটাধিকার আন্দোলন শুরু হয়। ১৯০৯ খ্রীষ্টাব্দে ২৭ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কের শ্রমিক মহিলাদের একটি সভা নারীর ভোটাধিকারের দাবি করে প্রস্তাব গ্রহণ করে। তারপর ১৯১০ খ্রীষ্টাব্দে ডেনমার্কের কোপেনহেগেন শহরে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে ১৭টি দেশের একশত নারী প্রতিনিধি যোগদান করেন। কমিউনিস্ট নেত্রী ক্লারা জেটকিন এই সম্মেলনেরও নেতৃত্ব করেন। এই প্রস্তাব গৃহীত হয় যে প্রতি বৎসর একটি দিন পূর্ণ বয়স্কা নারীদের ভোটাধিকার দাবি দিবস রূপে পালন করা হবে। মনে রাখতে হবে যে তখনকার দিনে নারীর ভোটাধিকার আন্দোলন ছিল একটি বিশেষ বৈপ্লবিক গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন। কারণ, তখন পর্যন্ত মাত্র কয়েকটি দেশে সীমাবদ্ধভাবে নারীর ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়েছিল। কেবলমাত্র ১৮৯৩ সালে নিউজিল্যান্ডে, ১৯০২ সালে সীমাবদ্ধভাবে অস্ট্রেলিয়াতে এবং ১৯০৬ সালে ফিনল্যান্ডে নারীদের ভোটাধিকার দেওয়া হয়েছিল। ১৮৪৮ সালের ১৯ মার্চ প্রাশিয়ার সম্রাট নারীদের ভোটাধিকার দিতে স্বীকৃত হয়েও তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন। সেজন্য জার্মানির মহিলাদের কাছে এই ১৯ মার্চ দিবসটি একটি দাবি দিবস রূপে চিহ্নিত হয়েছিল। তাই সেখানে ১৯১০ সালের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনের পর ১৯১১ সালের ১৯ মার্চ দিবসটি আন্তর্জাতিক নারীদিবস হিসাবে পালন করা হয়। তারপর ১৯১৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের শ্রমজীবী নারীরা মার্চ মাসের বিভিন্ন দিনে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ পালন করতে থাকেন। অবশেষে ১৯১৪ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ৮ই মার্চ দিবসটিকেই ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসাবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৯০৮ সালের ৮ই মার্চ নিউইয়র্কের দর্জি মেয়েরা নারীর ভোটাধিকারের জন্য ঐতিহাসিক আন্দোলন শুরু করে। অবশেষে সেই ৮ই মার্চ দিবসটিই শ্রমজীবী নারী আন্দোলনের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে রইল। সেই অবধি প্রতি বৎসর ৮ই মার্চ দিবসটিই ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসাবে শ্রমজীবী নারীদের সমানাধিকারের সংগ্রামের একটি প্রতীক দিবস রূপে চিহ্নিত হয়ে আসছে। ৮ই মার্চের ঐতিহ্য তাই বিশেষ বৈপ্লবিক তাৎপর্যপূর্ণ। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে ইউরোপ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে এইভাবে শ্রমজীবী নারী আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। বিভিন্ন দেশে গড়ে ওঠে বহু শ্রমজীবী নারীদের সংগঠন এবং গণতান্ত্রিক নারী আন্দোলন ও সংগঠন।
তারপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ও তৎপরবর্তী সময়েও এই ৮ই মার্চের সংগ্রামী ঐতিহ্য বিভিন্ন দেশের শ্রমজীবী নারীরা রক্ষা করে আসছে। ১৯১৭ সালের ৮ই মার্চ রাশিয়ার পেট্রোগ্রাড শহরে (বর্তমান লেনিনগ্রাড) শ্রমিক নারীরা অত্যাচারী জারের বিরুদ্ধে সভা ও মিছিল করে নারীদের দাবির আওয়াজ তোলে।
১৯৩৬ সালে স্পেনের লা পাশিওনারার (ডলোরাস ইবারুরী) নেতৃত্বে ৮ই মার্চ আশি হাজার শ্রমজীবী নারীর ফ্যাসিস্ত ফ্রাঙ্কো-বিরোধী শোভাযাত্রা মাদ্রিদ শহরের আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুলেছিল।
১৯৫০ সালের ৮ মার্চ পশ্চিম জার্মানির ৩,০০,০০০ (তিন লক্ষ) নারী চ্যান্সেলার আদেনুরকে শান্তির দাবিতে পুনরস্ত্রীকরণের বিরুদ্ধে পোস্টকার্ড পাঠিয়ে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল। ইরানের সুতাকল শ্রমিক নারীরা শান্তি ও রুজি রুটির দাবিতে শোভাযাত্রা করে এবং সেখানকার পঞ্চাশ হাজার নারী তৈলশিল্প জাতীয়করণের দাবিতে শোভাযাত্রা করে। এইভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এবং তৎপরবর্তী সময়েও কোরিয়ার যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে, নারী-পুরুষের সমান কাজে সমান মজুরির দাবিতে, খাদ্য ও জীবিকার দাবিতে, সমান অধিকারের দাবিতে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শ্রমজীবী নারীদের সংহতির দাবিতে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে ৮ই মার্চ দিবসটি ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসাবে বিভিন্ন স্তরের শ্রমজীবী নারীরা পরম শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে আসছে।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সর্বহারা শ্রেণীর আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত শ্রমজীবী নারী আন্দোলনের মহান ঐতিহ্য সম্পন্ন এই “৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস”। এই জন্যই সোভিয়েত রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর লেনিন ও স্তালিন প্রতি বৎসর এই দিবসটিকে পালন করার উপর বিশেষ জোর দিতেন। এই দিনে তাঁরা শোষিত নারী সমাজের আন্দোলন ও নারীমুক্তির প্রশ্নে সর্বহারাশ্রেণীর নীতি ও কর্মপদ্ধতি বারবার ঘোষণা করেছেন। বুর্জোয়াদের পরিচালিত নারী আন্দোলনের পাশাপাশি সর্বহারা শ্রেণীর আদর্শে পরিচালিত নারী আন্দোলনের আদর্শকে তুলে ধরেছেন।
১৯১৮ সালে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ উপলক্ষে লেনিন বলেন: “আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবসে পৃথিবীর সর্বত্র শ্রমিক নারীদের অসংখ্য সমাবেশে সোভিয়েত রাশিয়াকে অভিনন্দিত করা হবে। কারণ সোভিয়েত রাশিয়া শুরু করেছে এক অভূতপূর্ব কঠিন ও কষ্টসাধ্য, কিন্তু মহান, বিশ্বব্যাপকরূপে মহান এবং প্রকৃত মুক্তির কাজ। উৎসাহপূর্ণ আহ্বান জানানো হবে ক্রুদ্ধ ও কখনো কখনো পাশবিক বুর্জোয়া প্রতিক্রিয়ার সামনে ভেঙে না পড়ার জন্য। যে বুর্জোয়া দেশ যতই বেশি ‘স্বাধীন’ অথবা ‘গণতান্ত্রিক’, সেখানকার ধনিকের দল ততই বেশি ক্ষেপে ওঠে ও শ্রমিকদের বিপ্লবের উপর বর্বর অত্যাচার চালাতে থাকে। উদাহরণস্বরূপ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রিপাবলিকের কথা বলা যায়। কিন্তু শ্রমিক জনগণ ইতোমধ্যেই জেগে উঠেছে। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ শেষবারের মতো আমেরিকা, ইউরোপ ও পশ্চাৎপদ এশিয়ার তন্দ্রাচ্ছন্ন, অর্ধসুপ্ত রক্ষণশীল জনগণকে জাগিয়ে দিয়েছে।
“দুনিয়ার সর্বত্রই বরফ গলছে।”
“সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে জনগণের মুক্তি, ধনতন্ত্রের কবল থেকে পুরুষ ও নারী শ্রমিকদের মুক্তি এগিয়ে চলেছে দুর্নিবার গতিতে। এই লক্ষ্যের পথে আমাদের এগিয়ে দিচ্ছে লক্ষ লক্ষ পুরুষ ও নারী শ্রমিক পুরুষ ও নারী কৃষক। তাই দুনিয়ার ধনিকের কবল থেকে শ্রমিকের বিজয় অনিবার্য”। (আন্তর্জাতিক নারী দিবস, ১৯১৮)
রাশিয়ার বিপ্লবের পর ১৯২০ সালে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ উপলক্ষে লেনিন ঘোষণা করেন: “শ্রমজীবী নারী আন্দোলনের উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমান অধিকারের জন্য সংগ্রাম করা শুধু মামুলি আনুষ্ঠানিক সমান অধিকার নয়। এর প্রধান কাজ সামাজিক উৎপাদনের কাজের মধ্যে তাদের টেনে আনা, তাদের ‘পারিবারিক দাসত্ব’ থেকে উদ্ধার করা, অনন্তকাল ধরে কেবলমাত্র রান্নাঘর আর আঁতুড় ঘরের কাজে নির্বোধ, অবমাননাকর বশ্যতা থেকে তাদের মুক্ত করা....”(লেনিন, ৪ মার্চ, ১৯২০)
১৯২৫ সালে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে স্তালিন বলেন: “আন্তর্জাতিক নারী দিবসটি যেন অবশ্যই শ্রমিক নারীদের শ্রমিকশ্রেণীর মজুত শক্তি থেকে সর্বহারার মুক্তি আন্দোলনের সক্রিয় বাহিনীতে পরিণত করার উপায় হিসাবে কাজ করে।”
এইভাবে সর্বহারা শ্রেণীর মুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শ্রমজীবী নারী আন্দোলন এগিয়ে এসেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কাল পর্যন্ত অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত ইউরোপ, আমেরিকার ধনতান্ত্রিক দেশগুলিতে এই আন্দোলনের প্রথম পর্বের একটা ধারাবাহিক উজ্জ্বল চিত্র আমরা দেখতে পাই।

[তিন]
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সর্বহারাশ্রেণীর নেতৃত্বে শ্রমজীবী নারীদের এই আন্দোলনের ধারার পাশাপাশি উদারনৈতিক বুর্জোয়া নবজাগরণের আন্দোলন ও সংস্কারবাদী নারী আন্দোলনগুলির কথাও আলোচনা করা দরকার। একদিক থেকে ফরাসী বিপ্লবের প্রচণ্ড আলোড়ন ও অপর দিক থেকে ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের পর পাশ্চাত্য দেশগুলিতে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই বুর্জোয়া নবজাগরণের তরঙ্গ প্রবাহিত হতে থাকে। ইউরোপ আমেরিকার ধনতান্ত্রিক দেশগুলিতেই সেই নবজাগরণের যুক্তিবাদ ও মানবতাবাদের আলোকে পরাধীন নারী সমাজের অধিকার ও প্রগতির প্রশ্নটিও সামনে আসে। মধ্যযুগীয় সামন্ততন্ত্রের জগদ্দল পাথর ভেঙে প্রবল শক্তিশালী বুর্জোয়া শ্রেণীর নেতৃত্বে গড়ে উঠতে থাকে আধুনিক সভ্যতা। মার্কস-এঙ্গেলস ‘কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো’তে লিখেছেন: “ঐতিহাসিকভাবে বুর্জোয়ারা অত্যন্ত বৈপ্লবিক ভূমিকা গ্রহণ করেছে।”
‘বুর্জোয়ারা যেখানেই অগ্রণী ভূমিকা নিতে পেরেছে, সেখানেই সমস্ত সামন্ততান্ত্রিক পিতৃপ্রধান আদর্শবাদী সম্বন্ধের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছে।
[The bourgeosie, historically has played a most revolutionary part.
The bourgeosie wherever it has got the upperhand has put an end to all feudal patriarchal idyllic relations. - Communist Manifesto.]
সমাজ বিবর্তনের ক্ষেত্রে এক সময়ে ধনতন্ত্রের এমনই বৈপ্লবিক ভূমিকা দেখা গেছে। সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাকে ভেঙে চুরে ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে গড়ে তোলার মধ্যে সমাজের প্রচণ্ড বৈপ্লবিক পরিবর্তন দেখা যায়। আর এই পরিবর্তন সাধিত হয়েছে বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে। যদিও এ কথাও সত্য যে পুরাতন সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে গোটা জিনিসটাকে ঢেলে সাজাতে গিয়ে আবার পুরাতন সমাজের অনেক ভাল জিনিসও নষ্ট হয়ে গেছে। পুরাতন মানবিক সম্বন্ধ ও মূল্যবোধও ধ্বংস হয়ে গেছে। বুর্জোয়ারা মানুষের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের স্বীকৃতি দিয়েছে সত্য, কিন্তু সে আবার এতই নিদারুণভাবে যে সমাজের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ শিক্ষা কৃষ্টি সভ্যতার সব কিছুকেই নিছক টাকা পয়সার হিসাবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বুর্জোয়ারা এমনকি “পরিবারের মধ্যে থেকে পারস্পরিক মায়া মমতার সম্পর্ককেও ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে পারিবারিক সম্পর্ককেও শুধু মাত্র টাকা পয়সার সম্বন্ধে পরিণত করেছে”। [The bourgeosie has torn away from the family its sentimental veil, and has reduced the family relation to a mere money relation Communist Manifesto]
কিন্তু তবুও এ কথা সত্য যে সেই বুর্জোয়ারাই আবার এক সময় নতুন উন্নততর সমাজ গঠনের পথে অনেকখানি প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করেছে। আর ধনতন্ত্রের প্রসারের মধ্য দিয়ে বুর্জোয়া ও সর্বহারাশ্রেণীর শ্রেণীসংগ্রামও তীব্রতর হতে হতে আবার সমাজতন্ত্রের পথই প্রশস্ত হয়েছে। ইংল্যান্ডের অবস্থাটাই দেখা যাক। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে একদিক থেকে দেশের মধ্যে শিল্প বিপ্লব, অন্যদিক থেকে বিশ্ব কাঁপানো ফরাসী বিপ্লবের প্রভাবে সেখানে নতুন জীবনের জোয়ার এসেছে। আবার ওদিকে আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনার প্রায় এক দশক পরে (১৭৭৬) আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষিত হয়েছে। সমগ্র ইউরোপে ধনতন্ত্রের প্রসার এবং সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীন গণতান্ত্রিক ভাবধারার প্রসার চলেছে। শুরু হয়েছে এক নবজাগরণের যুগ। জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রসার দ্রুত হয়ে চলেছে। অ্যাডাম স্মিথ-এর ‘দি ওয়েল্থ অব নেশান’ [Adam Smith: The Wealth of Natiion, গ্রন্থ প্রকাশিত হয়ে গেছে অনেক আগেই (১৭৭৬)। তারপর জন স্টুয়ার্ট মিল-এর ‘পলিটিক্যাল ইকনমি’ (John Stuart Mill: Political Economy 1848), ‘অন লিবার্টি’ (On Liberty 1858), ‘সাবজেকশন অব উইমেন’ [Subjection of Women-1869, প্রকাশিত হয়েছে। চার্লস ডারউইন-এর ‘দি অরিজিন অব স্পেসিস’ (Charles Darwin: The Origin of Species 1859, প্রকাশিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ফরাসী বিপ্লবের প্রভাব, জার্মানির বড় বড় দার্শনিক গ্যেটে-শীলার-কান্ট-হেগেল প্রমুখের প্রভাব, ইংল্যান্ডের ডারউইন-মিল-বেন্থাম-স্পেনসার-হাক্সলি প্রমুখ চিন্তানায়ক মনীষী এবং সাহিত্য ক্ষেত্রে ব্লেক-বার্নস্-কোলরিজ-ওয়ার্ডসওয়ার্থ-শেলি-কিটস-বায়রন প্রমুখ লেখকদের প্রভাবে ঊনবিংশ শতাব্দীর চিন্তা ও ভাবজগতে অভূতপূর্ব আলোড়নের সৃষ্টি হলো। সেই উনবিংশ শতাব্দীতে সমগ্র ইউরোপের জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশের চরম শীর্ষে এসেই আবিষ্কার হয়েছে মার্কসবাদ। ধারাবাহিক ঐতিহাসিক বাস্তব পরিস্থিতির পরিণতির মধ্য দিয়েই মার্কসবাদের আবিষ্কার সম্ভব হয়েছে। এই প্রসঙ্গেই লেনিন বলেছেন: “মার্কসবাদী তত্ত্ব হলো সর্বশক্তিমান কারণ, মার্কসবাদ হলো অভ্রান্ত সত্য। ঊনবিংশ শতাব্দীতে মানুষ যে তিনটি শ্রেষ্ঠ জিনিস সৃষ্টি করেছিলেন জার্মানির দর্শন, ইংরাজদের রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতি এবং ফরাসীদের সমাজতন্ত্রবাদ তারই স্বাভাবিক উত্তরাধিকারী হলো মার্কসবাদ” (লেনিন : Vol. I)। সুতরাং এই উনবিংশ শতাব্দীতেই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদের দর্শন মার্কসবাদ আবিষ্কৃত হলো। মার্কস-এঙ্গেলস-এর ‘কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো’ প্রকাশিত হলো ১৮৪৮ খ্রীষ্টাব্দে (‘Communist Menifesto’: Marx-Engles: 1848), মার্কস-এর ‘দি ক্যাপিটাল ১৮৬৭ খ্রী: (“The Capital Vol. 1: 1867), এঙ্গেলস-এর ‘দি কনডিশন অব দি ওয়ার্কিং ক্লাস’ প্রকাশিত হলো ১৮৪৫ খ্রী: এবং ‘দি অরিজিন অব দি ফ্যামিলি প্রাইভেট প্রপারটি অ্যান্ড দি স্টেট ১৮৮৪ খ্রী: (Engels: The Condition of the Working Class in England: 1845, The Origin of the Family, Private Property and the State: 1884) অর্থাৎ ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই ধনতন্ত্রের পূর্ণ বিকাশের যুগে সমাজতন্ত্রের ভাবধারা ইতিমধ্যেই বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে বুর্জোয়া বজাগরণের যুক্তিবাদ ও মানবতাবাদের আন্দোলনের অন্যতম অঙ্গ হিসাবেই নারীর অধিকার আন্দোলনও শুরু হয়। নবজাগরণের প্রবক্তাগণ নারী-পুরুষের সম্বন্ধকে মানবিক যুক্তিবাদের আলোকে দেখেছেন। নারীর উপর যুগ যুগ ধরে সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার বর্বর নির্যাতনের বিরুদ্ধে তাঁরা সংগ্রাম করেছেন নারীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও ব্যক্তি সত্তাকে স্বীকৃতি দিয়ে নারী-পুরুষের সমান অধিকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেবার জন্য। যদিও বলা বাহুল্য নারীর পরাধীনতার প্রশ্নটিকে তাঁরা মার্কসবাদের মতো অর্থনৈতিক কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত করে শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করতে পারেননি। ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রগতিশীল বুর্জোয়া শ্রেণীর নেতৃত্বে ইউরোপ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে নারীর অধিকারের আন্দোলনগুলি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
এই আন্দোলনেও ইংল্যান্ড পুরোভাগে ছিল। ১৮৩০ খ্রীষ্টাব্দে ইংল্যান্ডে চার্টিস্ট আন্দোলনের মধ্যে নারীরা অংশগ্রহণ করে। তখন থেকেই নারী শিক্ষা, নারীর অধিকার, নারী প্রগতির প্রশ্নটি সমাজের বিভিন্ন স্তরে আলোড়ন সৃষ্টি করতে থাকে। ১৮৩৬ সালে ‘রিফর্ম বিল’-এর মধ্যে স্ত্রী-শিক্ষার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৮৩৩ সালে সমগ্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যর মধ্যে আইনত ‘দাস ব্যবসা’ (Slave Trading) নিষিদ্ধ করা হলো। এইভাবে একটি একটি করে প্রগতিশীল ব্যবস্থা চালু হতে থাকল। তখন ছিল রাণী ভিক্টোরিয়ার আমল (১৮৩৭-৯৭)। ১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দে জন স্টুয়ার্ট মিল ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টের সভ্য হবার পর নারীর ভোটাধিকারের উপর প্রস্তাব উত্থাপন করেন। নারীর অধিকারের আন্দোলনের উপর ন্যাশনাল সাফ্রেজিস্ট সোসাইটি’ (National Suffragist Society) ‘লেডিজ সোসাইটি’ (Ladies Society), ‘ডিসকাশন সোসাইটি’ (Discussion Society) প্রভৃতি অনেকগুলি সংগঠনও গড়ে ওঠে। নারীর ভোটাধিকার আন্দোলনের ফলে ১৮৬৯ খ্রীষ্টাব্দে ইংলন্ডে নারীদের পৌরসভার ভোটাধিকারের (Municipal Suffrage) দেওয়া হয়। ১৮৬৯ খ্রীষ্টাব্দে জন স্টুয়ার্ট মিল নারীর সমানাধিকারের উপর তাঁর বিখ্যাত পুস্তক ‘সাবজেকশন অব উইমেন’ (Subjection of women: John Stuart Mill 1869) লেখেন। তিনি বিস্তারিত আলোচনা করে দেখান যে আইনের কাছে সর্ববিষয়ে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার স্বীকার করে না নেবার কোনও প্রকার যুক্তি নেই, বা তার কোনো নৈতিক ভিত্তিও নেই। তিনি যুক্তিবাদের উপর ভিত্তি করেই দেখান যে নারীকে যদি একজন স্বতন্ত্র মানুষ বলে মনে করি তবে আইনত তাকে পুরুষের পরাধীন করে রাখার কোনো ভিত্তিই থাকতে পারে না। তিনি বিশেষ জোরের সঙ্গেই বলেন যে, “আমার উদ্দেশ্য হলো এই কথাই প্রমাণ করা যে আইনত নারীকে পুরুষের পরাধীন করে রাখা ভুল, এবং নারী-পুরুষের সর্বস্তরে সমান অধিকার থাকা উচিত।” [My object to prove that the legal subjection of women to men is wrong, and should give way to perfect equality subjection of Women’: John Stuart Mill] শুধু ভোটাধিকার নয়, বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদের সমান অধিকার, নারীর সম্পত্তির অধিকার প্রভৃতির উপরেও আন্দোলন শুরু হয়। ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দে মেরী কারপেন্টারের নেতৃত্বে নারীদের মানবিক অধিকারের জন্য সংগঠন তৈরি হয় এবং আন্দোলন হতে থাকে। এই সব আন্দোলনকেই ফেমিনিস্ট (Feminist) আন্দোলন বলা হয়ে থাকে। ১৮৫৭ খ্রীস্টাব্দে ইংল্যান্ডে বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদের বিল’ (Marriage and Divorce Act. 1857), ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দে বিবাহিত নারীর সম্পত্তির অধিকার বিল (Married Women’s Property Bill, 1882) প্রভৃতি কয়েকটি বিলে নারীদের অনেক অধিকারের আইনত স্বীকৃতি দেওয়া হলো। ইতিপূর্বে ইংল্যান্ডের ১৮৩৬ সালের ‘রিফর্ম বিল’-এর শিক্ষার অধিকারের মধ্যে নারীদেরও শিক্ষার অধিকার দেওয়া হয়।
১৯০৫ সালে মিসেস প্যাংখার্স্ট (Mrs. Pankharst)-এর নেতৃত্বে ইংল্যান্ডে নারীর ভোটাধিকারের উপর জোরদার আন্দোলন শুরু হয়। অনেক আন্দোলন, লেখালেখি, বাক্বিতন্ডার পর অবশেষে ১৯১৮ সালে ইংল্যান্ডে নারীর ভোটাধিকার আইনত স্বীকার করা হয় এবং ক্রমশ ক্রমশ ব্রিটিশ আইনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমান অধিকার স্বীকৃত হয়। ইউরোপে আমেরিকার অন্যান্য ধনতান্ত্রিক দেশেও ঠিক এইভাবেই নারীর আইনগত ও সামাজিক অধিকারের আন্দোলন এগিয়ে চলে এবং ক্রমশ ক্রমশ আইনগতভাবে নারীপুরুষের সমান অধিকারের দাবি আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করতে থাকে। সমাজে নারী প্রগতির ক্ষেত্রে এগুলি বিশেষ অগ্রগতির পরিচায়ক সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু বলা বাহুল্য যে ধনতান্ত্রিক সমাজের অর্থনৈতিক শ্রেণী দ্বন্দ্ব, শ্রেণীশোষণের অবস্থার জন্য অধিকাংশ নারীই সে সব অধিকার প্রকৃতপক্ষে ভোগ করতে পারে না।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত যে সমস্ত দাবি-দাওয়ার উপর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক নারী আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে তার মধ্যে নারীর ভোটাধিকারের আন্দোলনই ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। বলতে গেলে নারীর ভোটাধিকারের আন্দোলনই আন্তর্জাতিক রূপে নারী সমাজের প্রথম অধিকারের আন্দোলন। প্রায় শতাব্দীব্যাপী বিশ্বের দেশে দেশে এই আন্দোলনের সামাজিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য ঐতিহাসিক। পাশ্চাত্য দেশগুলিতে এই আন্দোলন দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে। নারীর ভোটাধিকার একটি বিশেষ রাজনৈতিক অধিকার। নারী-পুরুষের সমান অধিকারের ক্ষেত্রে এই অধিকারটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। আজ বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে এসে আমাদের কাছে নারীর ভোটাধিকার ব্যাপারটি খুবই সহজ মনে হতে পারে, কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীতে এই আন্দোলনটি ছিল নারী প্রগতির জন্য একটি মুখ্য আন্দোলন এবং বিশেষ বৈপ্লবিক তাৎপর্যপূর্ণ আন্দোলন।
এইসব আন্দোলনের ফলে বিভিন্ন দেশে নারীর ভোটাধিকার যেভাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে তার একটি আংশিক তালিকা নিচে দেওয়া গেল:
১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দ নিউজিল্যান্ড
১৯০২ ’’ অস্ট্রেলিয়া
১৯০৬ ’’ ফিনল্যান্ড
১৯১৩ ’’ নরওয়ে
১৯১৫ ’’ ডেনমার্ক ও আইসল্যান্ড
১৯১৭ ’’ ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোসালিস্ট রিপাবলিক, বাইলোরুশিয়া, ইউক্রেন,
১৯১৮ ’’ গ্রেটব্রিটেন, উত্তর আয়ারল্যান্ড, কানাডা,
১৯১৯ অস্ট্রিয়া, চেকোস্লাভাকিয়া, লুক্সেমবুর্গ, নেদারল্যান্ড, জার্মানি, পোল্যান্ড
১৯২০ ’’ যুক্তরাষ্ট্র
১৯২১ ’’ সুইডেন
১৯২২ ’’ বার্মা
১৯৩০ ’’ ইউনিয়ন অব সাউথ আফ্রিকা
১৯৩১ ’’ শ্রীলঙ্কা
১৯৩২ ’’ থাইল্যান্ড
১৯৩৪ ’’ তুরস্ক
১৯২১-৩৫ ’’ ভারত, পাকিস্তান
১৯৩৬ ’’ কোস্টারিকা
১৯৪০ ’’ কিউবা
১৯৪২ ’’ উরুগুয়ে, ডোমিনিকা রিপাবলিক
১৯৪৪ ’’ মঙ্গোলিয়া জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র
১৯৪৫ ’’ ইটালী, জাপান, বলিভিয়া, পর্তুগাল,
গুয়াতেমালা, যুগোস্লাভিয়া
১৯৪৬ ’’ আলবেনিয়া, এল সালভাদোর, পানামা,
রুমানিয়া, ব্রাজিল
১৯৪৭ ’’ আর্জেন্টিনা, বুলগেরিয়া, চীন, ভেনেজুয়েলা
১৯৪৮ ’’ ইসরাইল, কোরিয়া
১৯২০-৪৮ ’’ বেলজিয়াম
১৯৪৯ ’’ ইন্দোনেশিয়া, চিলি, সিরিয়া, গ্রীস
১৯৫০ ’’ হাইতি
১৯৫২ ’’ লেবানন
১৯৫৩ ’’ মেক্সিকো
১৯৫৪ ’’ কলম্বিয়া
১৯৫৫ ’’ হন্ডুরাস, পেরু, ভিয়েতনাম
১৯৫৬ ’’ নিকারাগুয়া, মিশর
১৯৫৭ ’’ তিউনিসিয়া
                                                 (তালিকা অসম্পূর্ণ)


(এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে রাষ্ট্রসংঘের সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় দেখা যায় যে এখনও পর্যন্ত (১৯৭৫) সার। বিশ্বের ৮০ কোটি (৮০০ মিলিয়ন) নিরক্ষরদের মধ্যে নারীদের সংখ্যা ৫০ কোটি (৫০০ মিলিয়ন) এবং অনুন্নত দেশগুলির মধ্যে শতকরা ৭০ জন নারীর কোনো ভোটাধিকার নেই।)
১৯৪৫ সালে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সনদে (Charter of UNO) নারীর সমান অধিকারও ঘোষণা করা হয়। নারীর সমান অধিকার আন্দোলনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে প্রায় সব দেশেই স্বাধীন উপার্জনের ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করবার নারীদের আইনত অধিকার আছে, এবং বলা বাহুল্য যে বর্তমান যুগে কাজ করবার অধিকার পাওয়ার সমস্যা বড় কথা নয়, নারীর বেকার সমস্যা বা কর্মসংস্থানের অভাবই মুখ্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু বিগত শতাব্দী পর্যন্ত অধিকাংশ দেশের নারীদেরই সর্বসাধারণের ক্ষেত্রে সে অধিকার ছিল না।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ইউরোপের বুর্জোয়া নবজাগরণের প্রভাব এশিয়া আফ্রিকার পরাধীন ও ঔপনিবেশিক দেশগুলির উপরও পড়তে থাকে। ভারতবর্ষেও ঊনবিংশ শতাব্দীতে এদেশে নবজাগরণের পুরোধা রামমোহন রায়ের সময় থেকে নারীর মানবিক অধিকারের প্রশ্নটি সামনে আসতে থাকে। নারীর উপর মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক নিষ্ঠুর প্রথা ও বিধিনিষেধগুলির বিরুদ্ধে সতীদাহ প্রথা, বহুবিবাহ প্রথা, নারীকে সম্পত্তির অধিকার থেকে, শিক্ষা-দীক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে রাখার ব্যবস্থা প্রভৃতির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে ওঠে ও আন্দোলন হতে থাকে। ‘সতীদাহ প্রথা’ আইনত নিষিদ্ধ হয় ১৮২৯ সালে। নারীশিক্ষা ও নারীর সামাজিক অধিকারের জন্য কিছু কিছু সংগঠন ও আন্দোলন গড়ে ওঠে। পরবর্তীকালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহ আইন প্রচলিত হয় এবং নারী শিক্ষার ও অধিকারের আন্দোলনের অগ্রগতি ঘটতে থাকে।
এইভাবে অভিজাত মহলের উদ্যোগেও নারীর অধিকার এবং নারী প্রগতির উপর কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংগঠনও গড়ে উঠেছে। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রসংঘ (ইউ এন ও) থেকেও নারীর সমান অধিকারের দাবি ঘোষণা করা হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়-তৃতীয় দশক পর্যন্ত প্রায় সমস্ত বুর্জোয়া গণতন্ত্রের দেশেই আইনত আনুষ্ঠানিকভাবে পুরুষের সঙ্গে নারীর সমান অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। কিন্তু সে সব দেশে ব্যাপকভাবে সমগ্র নারীজাতির প্রকৃত সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। একমাত্র ১৯১৭ সালে রাশিয়ার নভেম্বর বিপ্লবের পর শ্রমিকশ্রেণীর হাতে ক্ষমতা আসার পরই সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় শোষিত নারী সমাজের অনেকাংশে পূর্ণমুক্তি সম্ভব হয়েছে। নভেম্বর বিপ্লবের পর এই প্রসঙ্গেই লেনিন বলেছেন:
“বুর্জোয়া গণতন্ত্রে ও সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রে নারীদের অবস্থার যে সুস্পষ্ট পার্থক্য দেখা যায় তার থেকেই এই প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব মেলে।”
“পৃথিবীর কোথাও, এমন কি সবচেয়ে উন্নত দেশেও কোনও বুর্জোয়া গণতন্ত্রে অর্থাৎ যেখানে জমি, কারখানার কাজ, শেয়ার প্রভৃতির উপর ব্যক্তিগত মালিকানা রয়েছে, সেখানে নারীরা সম্পূর্ণ সমান অধিকার পায়নি। বিরাট ফরাসী (বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক) বিপ্লব হয়ে গেছে আজ দেড় শতাব্দীর উপর কিন্তু তা সত্ত্বেও সেখানে অবস্থা কিছু বদলায়নি।
“বুর্জোয়া গণতন্ত্র শুধু মুখে মুখেই সাম্য ও স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দেয়, কাজের বেলায় একটি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দেশে, এমন কি সবচেয়ে উন্নত দেশেও মানবজাতির অর্ধেক যে নারীসমাজ, তাদের আইনত পুরুষের সমান অধিকার অথবা পুরুষের শাসন ও দমন থেকে মুক্তি দেয়নি।”
“বুর্জোয়া গণতন্ত্র শুধু জাঁকালো গালভরা কথার বড় বড় প্রতিশ্রুতি, আর স্বাধীনতা ও সাম্যের নামে আড়ম্বরভরা ধ্বনির গণতন্ত্র। কিন্তু কাজের বেলায় এই গণতন্ত্র নারীদের স্বাধীনতাহীনতা ও নিকৃষ্ট অবস্থা এবং শ্রমিক ও শোষিত জনগণের স্বাধীনতাহীনতা ও নিকৃষ্ট অবস্থাকে ঢাকা দিয়ে রাখে।....”
“...... নারীজাতির মুক্তির জন্যও ‘শক্তিশালী’ পুরুষজাতির সাথে তাদের সমান আসনে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য দুই বৎসরের মধ্যে সোভিয়েত শাসন ইউরোপের একটি সবচেয়ে পশ্চাৎপদ দেশে যা করেছে, ১৩০ বৎসর ধরেও পৃথিবীর সমস্ত উন্নত, সভ্য, ‘গণতান্ত্রিক’ রিপাবলিকও তা করতে পারেনি।”
(লেনিন, প্রাভদা, নভেম্বর ৬, ১৯১৯)

[চার]
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নারীর ভোটাধিকারের উপরোক্ত আন্দোলনগুলির পাশাপাশি দেখা যায় নারী শ্রমিকদের পুরুষের সমান কাজে সমান মজুরির আন্দোলন, নারীর সামাজিক অধিকারগুলির জন্য আন্দোলন ও নারী শিক্ষার জন্য আন্দোলন চলতে থাকে। কিন্তু নারীর অধিকারের এই আন্দোলনগুলি বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকতে পারে না। দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত হয়ে যায়। কেবলমাত্র নারীর সমান অধিকারের সংগ্রাম বা রুটি রুজির সংগ্রাম থেকে স্বাধীন দেশগুলিতে রাজনৈতিক অধিকার, পরাধীন ও ঔপনিবেশিক দেশগুলির স্বাধীনতা, মুক্তি সংগ্রামের মধ্যে নারীরাও ক্রমশ ক্রমশ ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করতে থাকে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবস্থার মধ্যে বিভিন্ন দেশে নারীদের রাজনৈতিক সংগ্রামে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯১৪-১৮) জার্মানি, ফ্রান্স, রাশিয়াতে সেই সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবার জন্য সর্বস্তরের লক্ষ লক্ষ নারী সভা-সমাবেশ, শোভাযাত্রায় যোগ দিয়েছে। ১৯১৫ খ্রীষ্টাব্দে জার্মানির বার্ন শহরে ফরাসী, ইংল্যান্ড, পোল্যান্ড, ইতালী, সুইজারল্যান্ড ও রাশিয়ার সাম্যবাদী নারীদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনের মধ্য থেকে যুদ্ধের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ঘোষণা করা হয় এবং যুদ্ধবাদীদের ধিক্কার দেওয়া হয়। ১৯১৫ খ্রীষ্টাব্দে যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তি আন্দোলন সংগঠিত করার জন্য ‘লীগ অব উইমেন ফর পীস অ্যান্ড ফ্রীডম’ (League of Women for Peace and Freedom) নামে আন্তর্জাতিক নারী সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সময় বিভিন্ন স্তরের নারীদের মধ্যে যুদ্ধের বিরুদ্ধে কাজের জন্য অনেক সংগঠনই গড়ে ওঠে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে রাশিয়ায় ১৯১৭ সালে মহান অক্টোবর বিপ্লবের পর বিশ্ব সভ্যতার মুখ সমাজতন্ত্রের দিকে ঘুরে যায়। লেনিন এই সময়ের বিশ্ব পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করে বলেন: ‘সাম্রাজ্যবাদ হলো সর্বহারা বিপ্লবের পূর্বক্ষণ। এ সত্য ১৯১৭সাল থেকে বিশ্বব্যাপীভাবে প্রমাণিত হয়েছে। [Imperialism is the eve of the proletarian revolution. This has been confirmed since 1917 on a world-wide scale. July 6, 1920. Preface to Imperialism, the highest stage of Capitalism].
একদিক থেকে রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশে দেশে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ আদর্শে বৈপ্লবিক ভাবধারা ও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে, আবার অন্যদিক থেকে মহাযুদ্ধের শেষে চরম প্রতিক্রিয়া স্বরূপ ইতালী, জার্মানি ও স্পেনে ফ্যাসিবাদ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। বিংশ শতাব্দীর ৩য়, ৪র্থ দশকে ইউরোপের দেশে দেশে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনও সংগঠিত হতে থাকে। এই ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলন সর্বত্রই শ্রমিকশ্রেণী নতুন উদ্যমে এগিয়ে আসে। পরাধীন ও ঔপনিবেশিক দেশগুলির মুক্তি সংগ্রাম এবং স্বাধীনতা সংগ্রামেও নতুন গতিবেগ সঞ্চারিত হয়। এইসময়ে এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার পরাধীন ও ঔপনিবেশিক দেশগুলিতে স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্যে ব্যাপকভাবে সর্বস্তরের প্রগতিশীল নারীরা অংশগ্রহণ করতে থাকে। সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যে মুক্ত নারীসমাজের জন্ম দেয় তাদের আদর্শ সামনে রেখে শ্রমিকশ্রেণী ও তার পার্টি কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে শ্রমজীবী ও মধ্যবিত্ত নারীদের মধ্যে দেশে দেশে সংগঠন গড়ে উঠতে থাকে। তদানীন্তন ভারতবর্ষ ও অন্যান্য ঔপনিবেশিক পরাধীন দেশে স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে বহু নারী উজ্জ্বল উদাহরণ স্থাপন করেছে। নবজাগরণের সমাজ-চেতনা প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক নারীসমাজের মধ্যে যুদ্ধোত্তর বিশ্বে উন্নততর রাজনৈতিক চেতনার আলোকপাত করে।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ব্যাপকভাবে নারীরা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে আন্তর্জাতিক নারী আন্দোলনে নতুন রাজনৈতিক উদ্দীপনা আনে। ইতালী, জার্মানি, স্পেনে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে হাজারে হাজারে নারীরা কারারুদ্ধ হয়েছে, নির্বাসন বরণ করেছে, চরম অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আত্মদান করেছে। ফ্যাসিস্ত হিটলার নারীদের জন্য স্লোগান দিয়েছিল ‘রান্নাঘরে ফিরে যাও’ (Back to the Kitchen)। সামাজিক, রাজনৈতিক কাজ থেকে প্রগতিশীল নারীসমাজকে সরিয়ে নিয়ে চরম প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবস্থা চালু করতে চেয়েছিল হিটলার-মুসোলিনীর ফ্যাসিবাদ। কিন্তু সংগ্রামী নারীসমাজ তার যোগ্য প্রত্যুত্তরে হিটলারের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে খাস জার্মানিতেও পর্যন্ত আন্দোলন করেছিল। স্পেনে ফ্যাসিস্ত ফ্রাঙ্কোর বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট নেত্রী লা পাশিওনারা (ডলোরাস ইবারুরি)-র নেতৃত্বে শ্রমজীবী নারীদের মধ্যে ঐতিহাসিক আন্দোলন সংগঠিত হয়। ১৯৩৬ সালে ৮ মার্চ ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবসে’ আশি হাজার নারীর ফ্যাসিস্ত ফ্রাঙ্কো-বিরোধী শোভাযাত্রা মাদ্রিদ শহরের আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তোলে, সে কথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। এইরূপে বিভিন্ন দেশে নারীদের মধ্যে ফ্যাসি-বিরোধী আন্দোলন সংগঠিত হতে থাকে।
বিংশ শতাব্দীর ৩য়-৪র্থ দশকে নারীর অধিকারের আন্দোলনগুলি এইভাবেই দেশে দেশে রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্তভাবে অগ্রসর হতে থাকে।
১৯৩৯-৪৫ সালে রক্তস্নাত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে হিটলারের ফ্যাসিস্ত চক্রের চরম পরাজয় ঘটে। সমাজতান্ত্রিক শক্তি প্রসারিত হয়। পরাধীন ঔপনিবেশিক দেশগুলিতে স্বাধীনতার আন্দোলন অগ্রসর হয়। সারা বিশ্বে অভূতপূর্ব গণজাগরণ দেখা যায়। ফ্যাসি-বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রগতিশীল শিবিরগুলি বর্ধিত ও প্রসারিত হতে থাকে। এইসময় প্রগতিশীল আন্তর্জাতিক নারী আন্দোলনেরও নতুন পর্যায় শুরু হয়। দেশে দেশে ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলনে সর্বস্তরের প্রগতিশীল নারীসমাজ ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করতে থাকে। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়ার বীর নারীরা বর্বর নাৎসি আক্রমণের বিরুদ্ধে দেশরক্ষার সংগ্রামে অভূতপূর্ব বীরত্বের পরিচয় দিয়ে সমগ্র বিশ্বের বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। তখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফ্যাসি-বিরোধী কাজের জন্য নারীদের যে সব সংগঠন ও আন্দোলন গড়ে ওঠে, সোভিয়েত নারীরা ছিল তার পুরোভাগে।
১৯৪১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর সোভিয়েত রাশিয়ার মস্কোতে নারীদের একটি ফ্যাসি-বিরোধী সম্মেলন হয় এবং সোভিয়েত নারীদের ফ্যাসি-বিরোধী সংঘ গঠিত হয় (Soviet Women’s Anti-Fascist Committee)। ব্রিটেন আমেরিকা এবং অন্যান্য দেশের সংগ্রামী নারীদের প্রতিনিধিরা এই সমাবেশ উপলক্ষে রাশিয়ার সংগ্রামী নারীদের অভিনন্দন জানিয়ে বার্তা পাঠান। এই সমাবেশ থেকে হিটলার গোষ্ঠীর বর্বর ফ্যাসিস্ত আক্রমণের বিরুদ্ধে সংগ্রামে শামিল হবার জন্য আহ্বান জানিয়ে সারা বিশ্বের নারীসমাজের কাছে একটি ঐতিহাসিক আবেদন প্রচার করা হয়। এই আবেদনে বলা হয়: “সোভিয়েতের লক্ষ লক্ষ নারীদের পক্ষ থেকে, আপনাদের সকলের কাছে-আপনাদের রাজনৈতিক মতবাদ, জাতি, ধর্ম সামজিক স্তর নির্বিশেষে সকলের কাছে আমরা এই আবেদন করছি।
‘সমগ্র সভ্য জগতের পক্ষেই এই সংকটের মুখে আমরা আপনাদের হৃদয় ও চিন্তাশক্তির কাছে... বিশ্বের সমগ্র নারীসমাজ! এই হিটলার গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য সংযুক্ত মোর্চা গড়ে তুলুন।
‘আমাদের ঐক্যের মধ্যেই রয়েছে জয়ের শক্তি ও নিশ্চয়তা।
‘আমাদের সংগ্রাম ন্যায়ের সংগ্রাম, শত্রুর পরাজয় হবেই, আমাদের বিজয় সুনিশ্চিত।”
[“On behalf of the millions of Soviet women we appeal to you, irrespective of your political opinions, your religious beliefs, your social status.
‘In the face of the common danger menacing the whole civilized world we address this appeal to your heart and your reason....women of the world over: form a united front of struggle against sanguinary Hitlerism!
‘In our unity is strength and guarantee of Victory!
‘Ours is a righteous cause, the enemy will be defeated, we shall be Victorious!”]
সোভিয়েতের সংগ্রামী নারীদের উদ্যোগে এইভাবে ফ্যাসি-বিরোধী আন্দোলনের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নবপর্যায়ে বিভিন্ন স্তরের প্রগতিশীল নারী কমিটির দ্বিতীয় অধিবেশন হয় মস্কোতে ১৯৪২ সালের ১০ অক্টোবর। এই অধিবেশনে প্রথমেই কমরেড স্তালিনকে বিশ্ব শ্রমিকের এবং বিশ্বের নির্যাতিত নারী সমাজের অকৃত্রিম বন্ধু বলে উল্লেখ করে একটি প্রাণস্পর্শী প্রস্তাবে বলা হয়:
“প্রিয় কমরেড স্তালিন!
‘দেশপ্রেমিক যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী নারীদের এবং আমাদের লালফৌজের সংগ্রামী সৈনিকদের মাতা ভগ্নী স্ত্রী কন্যাদের এই সমাবেশ আপনাকে গভীর, আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছে।
‘আজ আপনাকে যিনি সোভিয়েত জনগণের প্রিয় নেতা, আমাদের সৈন্য বাহিনীর মহান অধিনায়ক এবং সোভিয়েতের নারী সমাজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু তাঁকেই আমরা, নারীরা, অতি সাধারণ কথায় আমাদের অভিনন্দন জানাই....
‘আপনার কথা আমরা সর্বদাই স্মরণ রাখব নারীরা এক মহান শক্তি....
‘আমাদের অন্তরের অন্তস্থল থেকে আমরা আপনার পূর্ণ স্বাস্থ্য কামনা করি, আমাদের প্রিয় নেতা ও প্রকৃত বন্ধু কমরেড স্তালিন।
‘আপনি আমাদের নেতৃত্ব দিন, শুধু আমাদের স্বামী-পুত্রদের, আমাদের পিতাদের ও ভাইদেরই নয় সোভিয়েতের নারীসমাজের বিরাট বাহিনীকে আপনি জার্মান ফ্যাসিস্ত সৈন্যবাহিনীদের বিরুদ্ধে বিজয় অভিযানে নেতৃত্ব দিন....”
[“Dear comrade Stalin!
“This meeting of women who are taking part in the patriotic war and the mothers, wives, daughter and sisters of our Red Army fighters sends you its most ardent and cordial greetings.
‘It is to you, the beloved leader of the Soviet people, the great captain of our armies and close friend of Soviet woman hood that we women address our simple words today.....we shall always be mindful of your words: ‘women are a great force’......from the bottom of our hearts we wish you the best health, our dear leader and true friend, Comrade Stalin!
Lead not only our sons, husbands, fathers, and brothers but also the huge army of Soviet womanhood to victory over the German fascist troops....”]
এই সমাবেশ থেকে পুনরায় বিশ্বের নারীসমাজের ফ্যাসি-বিরোধী ফ্রন্ট শক্তিশালী করার আহ্বান জানিয়ে বলা হয় ‘সারা বিশ্বে নারীদের ফ্যাসি-বিরোধী সংযুক্ত মোর্চা শক্তিশালী করে তুলুন’ (‘strengthen the United anti-fascist women front all over the world’)
এইভাবে কমরেড স্তালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত রাশিয়ায় যে ব্যাপকতম ফ্যাসি-বিরোধী নারী সংগঠন গড়ে উঠে তাদেরই উদ্যোগে সারা বিশ্বের সংগ্রামী নারীসমাজের সঙ্গে যোগসূত্র গড়ে ওঠে এবং আন্তর্জাতিক সংগঠনের পটভূমিকা প্রস্তুত হয়। বিশ্ব যুদ্ধের সময় বিশ্বের দেশে দেশে ফ্যাসি-বিরোধী আন্দালনে নারীরা অভূতপূর্ব বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে এই সময় ফ্যাসি-বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে জাপানি আক্রমণের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৪২ সালে তদানীন্তন অবিভক্ত বাংলাদেশে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি গড়ে ওঠে। পরবর্তীকালে এই সমিতিই যথাক্রমে ‘নিখিলবঙ্গ মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’ বঙ্গীয় প্রাদেশিক মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’ এবং দেশ বিভাগের পর ‘পশ্চিমবঙ্গ মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’ এবং পরে ‘পশ্চিমবঙ্গ মহিলা সমিতি’ নাম গ্রহণ করে। পরবর্তীকালে ১৯৭০ খ্রীষ্টাব্দে এই সমিতিরই অংশ দক্ষিণপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে পৃথক হয়ে যায় এবং ‘পশ্চিমবঙ্গ মহিলা সমিতি’ নামই বহাল রাখে। অপর অংশ বর্তমানে ‘পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি’ নাম গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ ছাড়া ভারতবর্ষের অন্যান্য কয়েকটি প্রদেশেও এই সময় কিছু কিছু অনুরূপ মহিলা সংগঠনও গড়ে ওঠে।

[পাঁচ]
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিশ্বব্যাপী রক্তদানের মধ্য দিয়ে অবশেষে ১৯৪৫ সালে গঠিত হলো আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক মহিলা ফেডারেশন বা Women’s International Democratic Federation. (সংক্ষেপে WIDF এবং বাংলায় বিশ্বনারী সংঘ বলা হয়।) তখন এই বিশ্বনারী সংঘের আশু এবং মুখ্য দায়িত্ব ছিল যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিশ্বশান্তি আন্দোলন গড়ে তোলা। ১৯৪৫ সালে ডিসেম্বর মাসে ফ্রান্সের প্যারিস শহরে প্রথম বিশ্বনারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। বলা বাহুল্য সোভিয়েত রাশিয়াই ছিল এই সম্মেলনের এবং বিশ্বনারী সংঘঠনের প্রধান উদ্যোক্তা। পৃথিবীর ৪০টি দেশ থেকে ১৮১টি নারী প্রতিষ্ঠানের ৮৫০ জন নারী প্রতিনিধি এই সম্মেলনে যোগ দেন। এই সম্মেলনে এক দিক থেকে আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইটালী প্রভৃতি বড় বড় ধনতান্ত্রিক দেশ থেকে শুরু করে মিশর, আলজিরিয়া, মরক্কো প্রভৃতি দেশগুলি থেকেও মহিলা প্রতিনিধিরা এসেছিলেন। সোভিয়েত রাশিয়ার নিনা পোপোভা, চীনের মাদাম সান ইয়াৎ সেন, ফ্রান্সের মাদাম রাসেল ও মাদাম প্রিন্ট, স্পেনের লা পাশিওনারা (ডলোরাস ইবারুরি), সুইডেনের এনড্রিন প্রমুখ বিখ্যাত মহিলা নেত্রীরা এই সম্মেলনের মঞ্চে মিলিত হন। এশিয়ার বহু দেশের মহিলা প্রতিনিধিরা এই সম্মেলনে যোগদান করেন। বাঙলার ‘মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’র তদানীন্তন সম্পাদিকা শ্রীমতী এলা রীড এই সম্মেলনে যোগদান করেন। কোন আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনের মঞ্চে ভারতের পক্ষ থেকে মহিলা প্রতিনিধির যোগদান করার প্রথম গৌরব হলো আত্মরক্ষা সমিতির প্রতিনিধির।
বিংশ শতাব্দীর চতুর্থ দশকে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বের রাজনৈতিক অবস্থার পটভূমিতে এই বিশ্বনারী সংঘই হয়েছিল নারীদের ব্যাপকতম আন্তর্জাতিক ফ্যাসি-বিরোধী গণপ্রতিষ্ঠান। বিশ্ব শান্তিরক্ষা ও ফ্যাসি-বিরোধী আন্তর্জাতিক সংহতিই ছিল এই সংগঠনের ব্যাপক ঐক্যের ভিত্তি। স্মরণ করা যেতে পারে যে জার্মান-জাপান-ইতালীর ফ্যাসিস্ত চক্রের বিরুদ্ধে কমরেড স্তালিনের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল, সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা ও ব্রিটেনের সঙ্গেও সংগঠিত হয়েছিল মিত্রশক্তি। ফ্যাসি-বিরোধী ব্যাপকতম ঐক্যই ছিল তখন মুখ্য প্রশ্ন। সেই আন্তর্জাতিক পটভূমিকাতেই ফ্যাসিস্ত হিটলার চক্রের বিরোধী সমাজতান্ত্রিক, ধনতান্ত্রিক, স্বাধীন পরাধীন বা ঔপনিবেশিক দেশগুলির বিভিন্ন শ্রেণীর ও সম্প্রদায়ের সর্বস্তরের নারীসমাজের একটা আশু কাজের ভিত্তিতে একটি ব্যাপক সংযুক্ত মোর্চা ছিল এই সংগঠন। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে ‘সোভিয়েত উইমেন্স অ্যান্টি ফ্যাসিস্ত কমিটি’ বিশ্বের নারীজাতির প্রতি এই আহ্বানই রেখেছিলেন: ‘সারা বিশ্বে নারীদের ফ্যাসিবিরোধী সংযুক্ত মোর্চা শক্তিশালী করুন।’ উক্ত আন্তজাতিক নারী-সম্মেলনের সহসভানেত্রী স্পেনের কমিউনিস্ট নেত্রী লা পাশিওনারার ভাষণ থেকেই এই বিশ্বনারী সংঘের আদর্শগত ভিত্তির কথা বোঝা যাবে। তিনি বলেছিলেন: “...... বিশ্বনারী সংঘের প্রত্যেকটির সভ্যের নিজের দিক থেকে তিনি সোস্যালিস্ট, কমিউনিস্ট, ক্যাথলিক, প্রটেস্টান্ট, মুসলিম, ইহুদি, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত কৃষক, বুদ্ধিজীবী-যা-ই হোন না কেন কেউ তাঁর মতবাদ বা শ্রেণী নিয়ে কোনো তর্ক তুলবার জন্য এ সম্মেলনে আসেননি.... কিন্তু একটিমাত্র দাবি তাদের কাছে, পৃথিবীতে শান্তি ও গণতন্ত্রকে তাঁরা রক্ষা করবেন, ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তাঁরা সংগ্রাম করবেন।”
এই ব্যাপক মানবিক আদর্শ নিয়ে বিশ্বনারী সংঘ তার সংগঠন ও কার্যধারা দেশে দেশে বিস্তার করতে থাকে। তারপর এই বিশ্বনারী সংঘ (WIDF) জাতিসংঘের (UNO) বেসরকারী ‘খ’ শ্রেণীভুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসাবে স্বীকৃত হলো, যার ফলে বিশ্বনারী সংঘ নারীদের ও শিশুদের সম্বন্ধে জাতিসংঘের (UNO) কাছে বিভিন্ন দেশের নারী ও শিশুদের অবস্থা সম্পর্কে সুপারিশ করবার, সংবাদ ও তথ্যাদি পেশ করবার অধিকারী হলো। বিশ্বনারী সংঘ প্রথম থেকেই জাতিসংঘের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এই দায়িত্বের কাজ করে আসছে।
বিশ্বনারী সংঘ তার সূচনা থেকেই যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তি আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে আসছে। ১৯৪৫ সালে সমগ্র বিশ্বের বুদ্ধিজীবীদের শান্তি কংগ্রেস অন্যতম উদ্যোক্তার ভূমিকা গ্রহণ করেছিল বিশ্বনারী সংঘ। স্টকহোম শান্তি আবেদনে ও পঞ্চশক্তি শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর সংগ্রেহের জন্য বিশ্বনারী সংঘের উদ্যোগে বিভিন্ন দেশের নারীরা এগিয়ে আসেন। ‘অ্যাটমবোমা বে-আইনী করো’-এই আবেদনে বিশ্বনারী সংঘের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম ইতালীর নারীরা ৩০ লক্ষ স্বাক্ষর সংগ্রহ করেন। ইরানের নারীরা স্টকহোম আবেদনে ৫ লক্ষ ও পঞ্চশক্তি শান্তি চুক্তিতে ২০ লক্ষ স্বাক্ষর সংগ্রহ করেন। এইভাবে ভারতসহ বিশ্বের দেশে দেশে যুদ্ধবিরোধী সংঘের উদ্যোগে নারীরা এগিয়ে আসেন। এইভাবে যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিশ্বশান্তির জন্য বিশ্বনারী সংঘ বহুমুখী কাজ করে। ১৯৫১ সালের ডিসেম্বর মাসে বিশ্বনারী সংঘ কোরিয়াতে একটি তদন্ত কমিশন পাঠান। এই কমিশনে ১৭টি দেশের ২১ জন মহিলা প্রতিনিধি ছিলেন। তাঁরা ফিরে এসে সর্বত্র কোরিয়ায় আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদীদের বীভৎস অত্যাচারের কথা বিবৃত করেন। এই কমিশন ফিরে আসার পর বিশ্বনারী সংঘ কোরিয়ায় আমেরিকার যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে দেশে দেশে আন্দোলন গড়ে তোলে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা কিভাবে নিষ্ঠুর হত্যালীলা কোরিয়াতে চালাচ্ছে সে বিষয়ে আমেরিকার জনগণের মধ্যে প্রচার আন্দোলন চালাতে থাকে। বিশেষ উল্লেখযোগ্য যে আমেরিকার নারীসংঘের নেতৃত্বে এক হাজার মা শিশু কোলে করে রাষ্ট্রসংঘের দপ্তরে (UNO) দরবারে গিয়ে এই হত্যালীলার প্রতিবাদ করেন। ওয়াশিংটন তাঁরা ‘মায়েদের কমিটি’ গঠিত করেন এবং কোরিয়ার বিরুদ্ধে ৫০ হাজার স্বাক্ষর সংগ্রহ করেন। এই সম্পর্কে বিশ্বনারী সংঘের তদন্ত কমিশন কর্তৃক প্রকাশিত ‘আমরা দায়ী করি’ (‘We Accuse’) নামক পুস্তিকাটি বহু ভাষায় বিভিন্ন দেশে প্রচারিত হয় ও সর্বত্র ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে সাম্রাজ্যবাদীরা কখনই কোরিয়ার এই বীভৎস বর্বরতার তথ্য উদ্‌ঘাটন করাকে ভালো চোখে দেখতে পারে না। তাই বিশ্ব নারী সংঘ উক্ত তদন্ত কমিশনের অনেককে আবার নিজ নিজ দেশে ফিরে গিয়ে অনেক নিগ্রহ সহ্য করতে হয়েছিল। যেমন এই কমিশনের সদস্য পশ্চিম জার্মানির লিলি ওয়াসারকে সত্য কথা বলার অপরাধে গ্রেপ্তার করা হয়। ইংল্যান্ডের মণিকা ফেলটনকে কর্পোরেশনের চেয়ারম্যানের পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়। এই সময়ে পিকিং শহরে অনুষ্ঠিত সারা এশিয়া শান্তি সম্মেলন এবং ভিয়েতনামে অনুষ্ঠিত বিশ্বশান্তি কংগ্রেসে অংশ গ্রহণ করে বিশ্ব নারী সংঘ পৃথিবীর সমস্ত মহাদেশে নারীদের মধ্যে শান্তি আন্দোলন শক্তিশালী করে তোলে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে এই সম্মেলনের ভারতীয় প্রতিনিধিদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির প্রতিনিধি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির সাধারণ সম্পাদিকা পঙ্কজ আচার্য এবং মঞ্জুশ্রী চট্টোপাধ্যায়। কোরিয়ার জীবাণু যুদ্ধের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের মানবিক অধিকার কমিটির অষ্টম অধিবেশনে বিশ্বনারী সংঘ জীবাণু অস্ত্র ব্যবহারের প্রতিবাদে ও তা নিষিদ্ধ করার জন্য এক স্মারকলিপি পাঠায়!
বিশ্ব নারী সংঘের ব্যাপক কর্মসূচীর মধ্যে নারীর সামাজিক অধিকারের আন্দোলন ও শিশু রক্ষার আন্দোলন হলো অন্যতম। নারীদের জন্য শিক্ষা ও কাজের অধিকার পুরুষের সমান কাজে সমান মজুরি, বিবাহ ও পারিবারিক জীবনের সর্বক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের জন্য নারী শ্রমিক, কৃষক ও ঔপনিবেশিক দেশের নারীদের উপর নির্যাতন অত্যাচারে বিরুদ্ধে এই সংঘ অনেক তদন্ত কমিশন, স্মারকলিপি, প্রচার-আন্দোলন সংগঠিত করেছে। ১৯৫২ সালে জেনেভার জাতিসংঘে অর্থনৈতিক ও সামজিক পরিষদে নারীদের অবস্থা সম্পর্কে কমিশনের ষষ্ঠ বৈঠকে বিশ্ব নারী সংঘের পক্ষ থেকে একটি স্মারকলিপি পাঠানো হয়। এই স্মারকলিপিতে বিশ্ব নারী সংঘ জাতিসংঘের কমিশনের কাছে নারীদের জন্য সমান কাজে সমান মজুরি, শিক্ষাক্ষেত্রে সমান সুযোগ-সুবিধা এবং শিশুদের রক্ষার জন্য আইন প্রণয়ন, মায়েদের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য (বিশেষ করে ঔপনিবেশিক দেশগুলিতে) সুব্যবস্থা, সামাজিক বীমা, সর্বক্ষেত্রে নারীদের পুরুষের সমান কাজের অধিকার প্রভৃতি দাবি করা হয়। বলা-বাহুল্য জাতিসংঘের উক্ত কমিশনের মধ্যে যথারীতি ব্রিটেন ও আমেরিকার বৃহৎ ধনিকগোষ্ঠীর প্রাধান্যই ছিল এবং তারা বিশ্ব নারী সংঘের প্রস্তাবগুলি বানচাল করে দেয়। বিশ্ব নারী সংঘ তাদের এই সব দাবি-দাওয়ার উপর ধারাবাহিকভাবে দেশে দেশে আন্দোলন-সংগঠন পরিচালনা করতে থাকে। নারীদের রাজনৈতিক অধিকারের বিশ্ব নারী সংঘ অনেক কাজ করে। মিশর আর্জেন্টিনা, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি যে সব দেশগুলিতে নারীদের ভোটাধিকার ছিল না বা খুবই সীমাবদ্ধভাবে ছিল, সে সব দেশে নারীদের পূর্ণ ভোটাধিকারের জন্য বিশ্বনারী সংঘ আন্দোলন সংগঠিত করে। দক্ষিণ আফ্রিকায় মাত্র সাদা চামড়ার নারীদেরই ভোটাধিকার ছিল। সেখানে বিশ্ব নারী সংঘ ভারতীয় ও নিগ্রো নারীদের ভোটাধিকার আন্দোলন সংগঠিত করেছিল। বলা-বাহুল্য যে পরবর্তীকালে সে অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। পরাধীন ও ঔপনিবেশিক দেশের নারীদের অধিকারের আন্দোলনগুলির পাশাপাশি বিশ্বনারী সংঘ সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন ও ইউরোপের নয়া গণতান্ত্রিক দেশগুলির মুক্ত নারীদের অবস্থা তুলে ধরেছে। সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীদের সর্বক্ষেত্রে পুরুষের সমান অধিকারের, নারীর প্রকৃত সামাজিক মুক্তির চিত্র তুলে ধরেছে ধনতান্ত্রিক, পরাধীন ও ঔপনিবেশিক দেশগুলির নারীদের কাছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ের মধ্য দিয়ে ইউরোপের নয়া গণতান্ত্রিক দেশগুলিতে (রুমানিয়া, আলবেনিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া, পোল্যান্ড, যুগোস্লোভিয়া, উত্তর কোরিয়া, পূর্ব জার্মানি এবং পরবর্তীকালে উত্তর ভিয়েতনাম) নতুন সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সেখানকার নারীদের সর্বক্ষেত্রে সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত হলো। ১৯৪৮ সালে মহাচীনের স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রের পথে চীনের দ্রুত অগ্রগতি সারা বিশ্বে তখন প্রচন্ড আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বলা-বাহুল্য সমাজতান্ত্রিক চীনের ভূখন্ডে শোষিত নারীসমাজের পূর্ণ মুক্তি সাধিত হয়েছে, তাদের সর্বক্ষেত্রে পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৪৯ সালে নয়া-চীনের নতুন গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হবার প্রথম থেকেই সেখানে বিবাহ আইন ও অন্যান্য সামাজিক আইনগুলি ও কার্যক্ষেত্রে নতুন সুযোগ-সুবিধাগুলি সেখানকার নারীদের জীবনে অভূতপূর্ব বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসে এবং তার প্রভাব অন্যান্য দেশের নারীসমাজের উপর বিস্তারিত হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিশুদের সর্বনাশ হয়েছে সবচেয়ে বেশি। লক্ষ লক্ষ শিশুর জীবননাশ হয়েছে। লক্ষ লক্ষ শিশু চিরদিনের মতো পঙ্গু হয়ে গেছে, অনাথ হয়ে গেছে। একমাত্র গ্রীসেই সরকারী হিসাব মতো ৭৫,০০০ শিশু পিতৃমাতৃহীন হয়েছিল। তিন লক্ষ গৃহহীন অনাথ হয়েছিল। ৩০,০০০ শিশু বন্দী হয়েছিল। এইসব শিশুদের সাহায্যকল্পে জাতিসংঘ থেকে একটি অর্থভান্ডার খোলা হয়। বিশ্ব নারী সংঘ অগ্রণী হয়ে সেই ভান্ডারে প্রচুর অর্থসংগ্রহ করে দেয় এবং বিশ্বের দেশে দেশে শিশুরক্ষার আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৯৫০ সালে বিশ্ব নারী সংঘ প্রতি বৎসর ১লা জুন তারিখটিকে ‘আন্তর্জাতিক শিশু দিবস’ হিসাবে ঘোষণা করে। সেই থেকে প্রতি বৎসর বিশ্বনারী সংঘের আহ্বানে বিভিন্ন দেশে ‘আন্তর্জাতিক শিশু দিবস’ পালিত হয়ে আসছে। ১৯৫২ সালের এপ্রিল মাসে ভিয়েনা শহরে বিশ্বনারী সংঘ একটি আন্তর্জাতিক শিশুরক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত করে। এই সম্মেলনের মূল বক্তব্য ছিল: শান্তিপূর্ণ পৃথিবীতে শিশুদের বাঁচার অধিকার, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকারকে সুরক্ষিত করা। এই সম্মেলনে ভারতবর্ষ থেকে ১৫ জন প্রতিনিধি যোগদান করেন। তারমধ্যে পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত শিশু চিকিৎসক ডাঃ কে সি চৌধুরী ছিলেন অন্যতম। এই সম্মেলনের পর ১লা জুন পৃথিবীর ৬০টি দেশে ব্যাপকভাবে আন্তর্জাতিক শিশু দিবস পালিত হয়।
পরাধীন ঔপনিবেশিক অনগ্রসর দেশগুলিতে নারীসমাজের দুর্দশার বিরুদ্ধে যে বহুবিধ আন্দোলন হয়েছে তাতে বিশ্ব নারী সংঘ সাহায্য করেছে। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মাদাম সিমোন বাত্রীর নির্দেশে বিশ্ব নারী সংঘের একটি কমিশন ভারত, মালয় ও বর্মাতে সফর করে। ইতিপূর্বে ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হয়েছে। ভারতে এই কমিশন সরকারী ও বেসরকারী অনেক প্রতিনিধিদের সঙ্গেই সাক্ষাৎ করেন এবং ভারতবর্ষে তাঁরা সমগ্র এশিয়ার নারীদের একটি সম্মেলন আহ্বান করতে চান। কিন্তু তদানীন্তন ভারত সরকার সম্মতি না দেওয়ায় সে সম্মেলন হতে পারেনি। ১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসে বিশ্ব নারী সংঘ এশিয়া আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার নারী ও শিশুদের দাসত্বের জীবন সম্পর্কে এক তথ্যমূলক রিপোর্ট জাতিসংঘের মানবিক অধিকার কমিটির কাছে পেশ করে। এইভাবে বিশ্বনারী সংঘের নেতৃত্বে বিশ্বের দেশে দেশে ব্যাপক গণতান্ত্রিক নারী আন্দোলন সংগঠিত হয়। সমাজতান্ত্রিক পূর্ব জার্মানির বার্লিন শহরে বিশ্ব নারী সংঘের কেন্দ্রীয় দপ্তর খোলা হয়। (এখন পর্যন্ত সেইখানেই এই দপ্তর আছে)। বিশ্ব নারী সংঘের মুখপত্র মাসিক পত্রিকা ‘উইমেন অব দি হোল ওয়ার্ল্ড’ (Women of the Whole World) বিভিন্ন ভাষায় ব্যাপকভাবে প্রচারিত হতে থাকে।
তাছাড়াও বিশ্ব নারী সংঘ অনেক তথ্যমূলক ও প্রচারমূলক বই প্রকাশ করেও বহুলভাবে প্রচার করে আসছে।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিশ্ব নারী সংঘের সূচনা থেকেই ভারতের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়। ভারতের বিভিন্ন স্তরে মহিলা সংগঠনগুলি বিশ্ব নারী সংঘের যুদ্ধ-বিরোধী শান্তি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়। এই আন্দোলনের মধ্যে একদিক থেকে যেমন কংগ্রেসের নেত্রীরা এবং নিখিল ভারত মহিলা সম্মেলনের (AIWC) অভিজাত নেত্রীরা সূচেতা কৃপালিনী, অরুণা আসফ আলি, রাজকুমারী অমৃত কাউর, রামেশ্বরী নেহরু, সারাবেন মেহতা প্রমুখ ছিলেন, তেমনি অন্যদিক থেকে কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে গঠিত শ্রমিকশ্রেণীর সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন রাজ্যের মহিলাদের গণ-প্রতিষ্ঠানগুলিও অগ্রণী হয়ে আসে। তার মধ্যে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি (যার থেকে বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি গঠিত হয়েছে) ছিল অন্যতম।
১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিশ্ব নারী সংঘের যে প্রতিনিধি দলটি (এশিয়া কমিশন) ভারতে আসেন তাঁদের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির যোগাযোগ স্থাপিত হয় এবং বিশ্ব নারী সংঘের মাধ্যমেই আন্তর্জাতিক নারী আন্দোলনের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি যুক্ত হয়। এই কমিশন দেশে ফিরে গিয়ে যে রিপোর্ট পেশ করেন তার ভিত্তিতে ১৯৪৮ সালের মে মাসে পশ্চিমবঙ্গ মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি, অন্ধ্র মহিলা সংঘ প্রভৃতি কয়েকটি ভারতীয় মহিলা সংগঠনকে বিশ্ব নারী সংঘের সঙ্গে যুক্ত (affiliated) করা হয়।
১৯৫৩ সালের জুন মাসে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত বিশ্ব নারী কংগ্রেসে ভারতবর্ষ থেকে ২৭ জন প্রতিনিধি যোগদান করেন। তাঁদের মধ্যে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির প্রতিনিধি ছিলেন ৪ জন। বিশ্ব নারী কংগ্রেসে নারীর অধিকারের উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ সনদ পেশ করা হয়। কোপেনহেগেন সম্মেলনের পর ভারতের বিভিন্ন মহিলা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ও কয়েকজন বিশিষ্ট মহিলাকে নিয়ে একটি মহিলা কো-অর্ডিনেশন কমিটি গঠিত হয়। এই কো-অর্ডিনেশন কমিটির আহ্বানে ১৯৫৪ সালের ৪ জুন কলিকাতায় একটি সারা ভারত মহিলা কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে ব্যক্তিগতভাবে এবং বহু সংগঠন থেকে মহিলা প্রতিনিধিরা এই কংগ্রেসে যোগ দিতে আসেন। বিশ্ব নারী সংঘ থেকে ভ্রাতৃত্বমূলক প্রতিনিধিরা আসেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ব্রিটেনের ডোরা রাসেল ও অস্ট্রেলিয়ার বেটি র‍্যালে। বলা বাহুল্য পশ্চিমবঙ্গ মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি ছিল এই অনুষ্ঠানের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা। এই সারা ভারত মহিলা কংগ্রেস থেকেই ভারতীয় জাতীয় মহিলা ফেডারেশন (National Federatioin of Indian Women) গঠিত হয়। এই ফেডারেশন হলো দলমত নির্বিশেষে বিভিন্ন মহিলা সংগঠনগুলির একটি সমন্বয় সংগঠন। ব্যক্তিগতভাবেও কিছু সংখ্যক মহিলা এই ফেডারেশনে যোগ দেন। জনগণের ব্যাপক গণতান্ত্রিক অধিকার নারী এবং শিশুদের জন্য সাধারণ অধিকারগুলির জন্য কাজের ভিত্তিতেই এই ফেডারেশন গঠিত হয়। উদারপন্থী, বামপন্থী, দক্ষিণপন্থী, কমিউনিস্ট সর্বস্তরের মহিলারা এর মধ্যে থাকেন। এমন কি কিছু কিছু কংগ্রেসী মহিলাও এর সঙ্গে যুক্ত থাকেন। এই ফেডারেশনের প্রথম সভানেত্রী হলেন শিক্ষাবিদ পুষ্পময়ী বসু এবং যুগ্ম-সম্পাদিকা হলেন অনুসূয়া জ্ঞানচাঁদ এবং হাজরা বেগম; ব্যাপক জাতীয় গণতান্ত্রিক ঐক্যই ছিল এই সংগঠনের মূল নীতি। ভারতীয় জাতীয় মহিলা ফেডারেশনের মূল উদ্দেশ্যের মধ্যে ঘোষণা করা হলো: “এই ফেডারেশন নারী পুরুষের সমান অধিকারের ভিত্তিতে এবং সামাজিক ন্যায়, শারীরিক, মানসিক, নৈতিক ও শিক্ষা সংস্কৃতিগত উন্নতির জন্য ভারতীয় নারীসমাজের সামাজিক, অর্থনৈতিক, কৃষ্টিমূলক এবং রাজনৈতিকভাবে পূর্ণ মুক্তির জন্য কাজ করবে এবং শিশুরক্ষার জন্য, মায়েদের অধিকার রক্ষার জন্য এবং সমগ্র নারীজাতির সুখী মাতৃত্বের অধিকার রক্ষার জন্য কাজ করবে।”
[“The Federation shall work for the complete social, economic, cultural and political emancipation of Indian women based on equality of rights between men and women, and full social justice, physical, intellectual, moral, artistic and educational well being, security of children and protection of the rights of mothers and ensurance of a happy motherhood for all women.” Constitution of the National Federation of Indian Women].
এই ভারতীয় জাতীয় মহিলা ফেডারেশন বিশ্বনারী সংঘের শাখা হিসেবে সেই থেকেই ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কাজ করে আসছে।
বিশ্ব নারী সংঘের আহ্বানে বিভিন্ন সময়ে ভারতের প্রতিনিধিরা নানা দেশে গিয়েছেন। ১৯৫৫ সালে সুইজারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বিশ্ব মাতৃ সম্মেলনে (World Mother Congress) ভারতবর্ষ থেকে ৪৫ জন প্রতিনিধি যোগ দিয়েছিলেন। তার মধ্যে পশ্চিমবাংলা থেকেই গিয়েছিলেন ২২ জন। তাছাড়াও বিভিন্ন সময়ে পশ্চিমবাংলা থেকে প্রতিনিধিরা বিশ্ব নারী সংঘের আহ্বানে চীন, সোভিয়েত, ইউরোপ ও এশিয়ার অন্যান্য দেশে গিয়েছেন।
১৯৬০ সালে বিশ্ব নারী সংঘের উদ্যোগেই সারা বিশ্বে ব্যাপকভাবে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’-এর ৫০ বৎসর পূর্তি উপলক্ষে তার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করা হয়। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে ১৯১০ সালে অনুষ্ঠিত ২য় আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলনেই প্রথম প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় প্রতি বৎসর আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করার এবং তারপর ক্রমে ৮ মার্চ দিবসটিতেই প্রতি বৎসর আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সেই অবধিই আন্তর্জাতিক নারী দিবস প্রতি বৎসর পালিত হয়ে আসছে। ১৯৬০ সালে ব্যাপকভাবে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’-এর সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করা হয়। এই জয়ন্তী উৎসবের মুখ্য বিষয় হিসাবে বিশ্ব নারী সংঘ ঘোষণা করে ‘নারীর অধিকারের সংগ্রাম ও শান্তির সংগ্রাম’। সোভিয়েত রাশিয়া, চীন, ভারত, জাপান, বুলগেরিয়া, পূর্ব জার্মানি, কানাডা, লেবানন, অস্ট্রেলিয়া, গ্রেট ব্রিটেন, বেলজিয়াম, মঙ্গোলিয়া, স্পেন, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, সুদান, সুইজারল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি বিশ্বের বহু দেশে ব্যাপকভাবে এই আন্তর্জাতিক নারী দিবসের সুবর্ণজয়ন্তী পালন করা হয়।
ভারতবর্ষে ভারতীয় জাতীয় ফেডারেশনের উদ্যোগে পশ্চিমবাংলায় এবং ভারতের অন্যান্য কয়েকটি রাজ্যে বিশেষ সমারোহের সঙ্গে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করা হয়। এই উপলক্ষে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসবে পশ্চিমবঙ্গ কমিটির উদ্যোগে ৯-১০ মার্চ, ১৯৬০, কলকাতা ইডেন উদ্যানে বিশেষ সমারোহের সঙ্গে এই উৎসব পালন করা হয়। এই উৎসবের অন্যতম বিশেষ উদ্যোক্তা ছিল পশ্চিমবঙ্গ মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি। এই সমিতির তদানীন্তন মুখপত্র ‘ঘরে বাইরে’ পত্রিকার একটি বিশেষ সংখ্যাও এই উপলক্ষে প্রকাশিত হয় (ঘরে বাইরে: আন্তর্জাতিক নারী দিবস সুবর্ণ জয়ন্তী সংখ্যা, চৈত্র, ১৩৬৬, এপ্রিল, ১৯৬০)। এই সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে বিশ্ব নারী সংঘের তদানীন্তন সভানেত্রী ইউজিন কোঁতো তাঁর বিশেষ বাণীতে বলেন “অতীতের তুলনায় আজকের দিনের নারী প্রগতি বর্তমান বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই দিক দিয়ে দেখতে গেলে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের পঞ্চাশতম জয়ন্তী শুধু নারী আন্দোলনের পক্ষেই নয়, সমগ্র মানবজাতির পক্ষেই একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।
‘আজকের’ দিনে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার ও ন্যায্য দাবির সমস্যা আমাদের সকলের সামনেই রয়েছে। যে জনগণ ১৯১৭ সালের মহান অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত করেছিল, তারা এ সমস্যার কথা বুঝেছিল আর সেই বিপ্লবই নারীকে দিয়েছিল পুরুষের সমান অধিকার। সমান অধিকার ছাড়া নারী তার মানবিক মর্যাদা পেতে পারে না, আর সে মর্যাদা পাবার অধিকার আছে সকল মানুষের, কালোই হোক, সাদাই হোক, হলুদই হোক, আর খ্রীষ্টান, মুসলমান বা ইহুদিই হোক- নরনারী নির্বিশেষ সমস্ত মানুষের। ....১৯১৭ সালের মহান অক্টোবর বিপ্লব সোভিয়েত ইউনিয়নে এক নতুন ধরনের নারীর জন্ম দিয়েছে। তারপর নাৎসি জার্মানির পরাজয়ের পর জনগণতান্ত্রিক দেশগুলিতে ও চীনে নতুন ধরনের নারীসমাজের অভ্যুদয় হয়েছে। ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার নারীরা তাদের দ্বিগুণ শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়েছে বিদেশী শোষণ ও পুরাতন পারিবারিক ঐতিহ্যের শোষণ এবং ফরাসী, ব্রিটেন ও ইতালীতেও মেয়েরা জনজীবনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করতে শুরু করেছে। আফ্রিকা মহাদেশের সর্বত্র আজ স্বাধীনতা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক সমাবেশে আরব এবং নিগ্রো মেয়েরা যে সাহস ও মর্যাদার পরিচয় দিয়েছেন তাতে আমরা অভিভূত হয়েছি। .... এই শতাব্দীর প্রথম থেকেই নারীর বিজয় হয়েছে, সে শুধু যে সব সুদূরপ্রসারী ঘটনাবলী অনেক শৃঙ্খল চূর্ণ করেছে সে জন্যই নয়, যে সব সাহসী রমণীগণ আমাদের সামনে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন শুধু তাঁদের জন্যই নয়, প্রতি বৎসর ব্যাপকতরভাবে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের অনুষ্ঠান এবং তাঁর স্থায়ী ঐতিহ্যের জন্যও হয়েছে।....”
মাদাম ইউজিন কোতোঁর এই তাৎপর্যপূর্ণ বাণী থেকেই বোঝা যায় যে আন্তর্জাতিক নারীদিবসের সেই স্থায়ী ঐতিহ্যের পথে মহান অক্টোবর বিপ্লবসৃষ্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের নতুন ধরনের নারীদের নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল বিশ্ব নারী সংঘ। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে শ্রমজীবী নারীদের যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, ১৯০৭ সালে জার্মানির স্টাটগার্টে প্রথম সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলনের মধ্য দিয়ে যে আন্দোলন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সংহতি লাভ করে, মার্কসবাদী আদর্শের পথে পরিচালিত যে আন্দোলনের পুরোভাগে প্রথমেই আমরা দেখতে পাই বিশ্ব বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেত্রী ক্লারা জেটকিনকে, সেই আদর্শের পথেই এগিয়ে চলেছিল বিশ্বের দেশে দেশে শ্রমজীবী নারীরা। সেই আদর্শের পথেই বেড়ে চলেছিল ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’-এর ঐতিহ্য। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত রাশিয়ার নারীদের মধ্যে আমরা সর্বপ্রথম দেখতে পাই নারীর পূর্ণ মুক্তির প্রথম রূপ। তাই মাদাম কোঁতো অত্যন্ত সঠিকভাবেই বলেছিলেন যে মহান অক্টোবর বিপ্লব জন্ম দিয়েছে সেখানে নতুন ধরনের নারীদের। স্বভাবতই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কমরেড লেনিন-স্তালিনের নির্দেশিত পথে তাঁরাই এগিয়ে এসেছিলেন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নারী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে এবং তাঁদেরই নেতৃত্ব গঠিত হয়েছিল ও যাত্রা শুরু হয়েছিল বিশ্ব নারীসংঘে (Womens International Democratic Federation), ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’-এর মহান ঐতিহ্যের পতাকা তুলে ধরেছিল এই বিশ্ব নারী সংঘ। বিশ্বের শোষিত নিপীড়িত নারী সমাজকে বিশ্বসমাজতন্ত্রের বৈপ্লবিক যাত্রাপথে পরিচালনা করবার মহান শক্তি ও সম্ভাবনা ছিল বিশ্ব নারী সংঘের। বিশ্বের শোষিত নারী সমাজের প্রত্যাশা ছিল যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ফ্যসি-বিরোধী আন্দোলনের জন্য বিশ্ব নারী সংঘের মাধ্যমে যে ব্যাপকতম গণতান্ত্রিক ঐক্য দেশে দেশে গড়ে উঠেছিল, পরবর্তী সময়ে তা বৈপ্লবিক তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠবে, শ্রেণী সংগ্রামের চেতনায় পুষ্ট হয়ে সেই সংগঠন হয়ে উঠবে সাম্রাজ্যবাদ ও ধনিকশ্রেণীর কায়েমী স্বার্থের বিরুদ্ধে সংগ্রামের শক্তিশালী হাতিয়ার, এগিয়ে নিয়ে যাবে বিশ্বের নারী সমাজকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে শোষিত নারী জাতির পূর্ণ মুক্তির পথে। বিশ্বের বিপ্লবী সর্বহারা শ্রেণীর সঙ্গেই হবে এই সংগঠনের প্রধান যোগসূত্র। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো এই যে বিশ্ব নারী সংঘ শোষিত নারী সমাজের সে প্রত্যাশা পূরণ করতে পারল না। বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অনৈক্য এবং সোভিয়েত পার্টির সংস্কারবাদী ঝোঁকের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব নারী সংঘের মধ্যেও তার প্রভাব পড়ল। বিশ্ব নারী সংঘ ক্রমশ বিভিন্ন দেশের ধনিক বুর্জোয়া শাসকদের সঙ্গে আপসের পথ ধরে তথাকথিত ‘প্রগতিশীল ও সংস্কারবাদী’ নারী আন্দোলনের পথ ধরে চলতে থাকল। বিগত পঞ্চাশ দশকের শেষার্ধে বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক শিবিরের মধ্যে যখন মত পার্থক্য প্রকট হতে থাকল, তখন চীন এবং অন্যান্য কয়েকটি সমাজতান্ত্রিক দেশের নারী সংগঠনগুলি বিশ্ব নারী সংঘ থেকে সরে গেল। ভারতবর্ষেও বিশ্ব নারী সংঘের শাখা হিসেবে ভারতীয় মহিলা ফেডারেশন ভারতের কংগ্রেস সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার পথেই মামুলি ধরনের নারী আন্দোলন ও সংগঠনের মধ্যেই সীমাবদ্ধভাবে কাজ করতে থাকল। এই সংগঠনের মধ্যে ভারতের দক্ষিণপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির নেত্রীরাই মুখ্য ভূমিকায় আছেন। বলা বাহুল্য বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি এখন আর ভারতীয় জাতীয় মহিলা ফেডারেশন। বা বিশ্বনারী সংঘের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত নাই। তার কারণ পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি মূলত কংগ্রেস সরকারের বিরোধী। এই সমিতি বিশ্বাস করে যে সমাজের আমূল বৈপ্লবিক পরিবর্তন ছাড়া, প্রকৃত সমাজতান্ত্রিক, শোষণহীন সমাজ ছাড়া শোষিত নারীজাতির পূর্ণ মুক্তি সম্ভব নয় এবং ভারতবর্ষে সেই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জন্য সেই পথের সবচেয়ে বড় বাধা কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতেই হবে। এই মূল আদর্শগত পার্থক্যের জন্য বিশ্ব নারী সংঘ বা জাতীয় মহিলা ফেডারেশনের (এবং তার সঙ্গে সংযুক্ত পূর্বের মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির একাংশ বর্তমানে দক্ষিণপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে পরিচালিত পশ্চিমবঙ্গ মহিলা সমিতির) সঙ্গে যুক্ত থাকা সম্ভব নয়। তবে সাময়িকভাবে বিশেষ বিশেষ দাবির উপর আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক সঙ্গে কাজ করে থাকে।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বিশ্বনারী সংঘ শোষিত-নিপীড়িত নারী সমাজের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারল না কিন্তু তার পরিবর্তে সেই প্রত্যাশা পূরণের জন্য শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে অন্য কোন আন্তর্জাতিক নারী সংগঠনও গড়ে ওঠেনি। ওদিকে চীন এবং অন্যান্য যে সমাজতান্ত্রিক দেশের নারীরা বিশ্ব নারী সংঘ থেকে সরে গেল, তারাও নিজ নিজ দেশের মধ্যেই তাদের কর্মস্থল সীমাবদ্ধ রাখল। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে নতুন করে আর কোনো নারী সংগঠন গড়ে ওঠেনি। বলা বাহুল্য বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক শিবিরের মধ্যেই যদি অনৈক্য ও মতপার্থক্য থাকে তবে বিশ্বে সমাজতন্ত্রের আদর্শে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন গড়ে উঠবে কেমন করে?
সোভিয়েতের নেতৃত্বে বিশ্ব নারী সংঘ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাম্রাজ্যবাদী এবং গণতান্ত্রিক দেশগুলিতে বিস্তারলাভ করেছে। পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে যে বিশ্ব নারী সংঘ জাতি সংঘের বেসরকারী ‘খ’ শ্রেণীভুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসাবে স্বীকৃত হয় এবং গোড়া থেকেই নারীদের ও শিশুদের অধিকার রক্ষার কাজে জাতি সংঘের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা চলে। এই সূত্রেই বর্তমান ১৯৭৫ সালটিকে যে জাতি সংঘ থেকে ‘আন্তর্জাতিক নারীবর্ষ’ (International Women’s Year) হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে তার পিছনেও বিশ্ব নারী সংঘের অবদান রয়েছে।

[ছয়]
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, ১৯৪৫ সালে রাষ্ট্রসংঘের (UNO) সূচনাতেই রাষ্ট্রসংঘের সনদের মধ্যেই (UNO Charter) নারীর সমান অধিকারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের প্রস্তাবেও (Resolution of the General Assembly, 7 Nov. 1967) বলা হয় “আইনত ও নীতিগতভাবে নারী পুরুষের সর্বতোভাবে ও সর্বজনীনভাবে সমান অধিকারের জন্য জাতি সংঘের ঘোষণাকে মেনে নিচ্ছে।” [The Assembly proclaims the Declaration “to ensure the Universal recognition in law and in the face of principle of equality of men and women.”] জাতিসংঘের ঘোষণার প্রথম অনুচ্ছেদেই বলা হয়েছে: “নারীদের প্রতি কোনরূপ বৈষম্যমূলক আচরণ অথবা তাঁদের সমান অধিকারকে অস্বীকার করা বা কোনরূপে সংকুচিত করা হলো মূলত অন্যায় এবং মানবিক মর্যাদার বিরুদ্ধে অপরাধমূলক।” [“Discrimination against women, denying or limiting as it does their equality of rights with men, is fundamentally unjust and constitues an offence against human dignity” - (Article I. UNO Declaration on the elimination of discrimination against women).] জাতিসংঘের এই ঘোষণাপত্রের মোট ১১টি ধারার সর্বক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমান অধিকারের নীতির কথা এবং তা কার্যকরী করবার প্রচেষ্টার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। বলা বাহুল্য জাতিসংঘের পক্ষ থেকে নারীর অধিকারের উপর এই সব আনুষ্ঠানিক ঘোষণা মূলত আনুষ্ঠানিক পর্বেই সীমাবদ্ধ থেকে যায় এবং কার্যক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের অগণিত শোষিত নারীসমাজের উপর সামাজিক বৈষম্য দূর করার বা শোষণ নিপীড়নের মৌলিকভাবে অবসানের ক্ষেত্রে কোনো কাজেই আসে না। কারণ উপর থেকে জাতিসংঘে আনুষ্ঠানিক ঘোষণার দ্বারা কোন দেশেই তার সামাজিক অবস্থার বা অর্থনৈতিক কাঠামোর মূলগত পরিবর্তন হয় না, মুখের কথাতে নারীর দাসত্বও এতটুকু শিথিল হয় না। এই বাস্তব সত্য ও রাষ্ট্রসংঘের পক্ষ থেকে ঢাকঢোল পিটিয়ে নারীর অধিকার সম্বন্ধে তাদের কার্যকলাপের প্রচারের মধ্যে রয়েছে সেই আকাশ পাতাল তফাৎ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রাষ্ট্রসংঘের একটি আন্তর্জাতিক কমিশন (UNO commission on the status of women) গঠিত হয়। ১৯৪৭ সালে নিউইয়র্কে এই কমিশনের প্রথম অধিবেশন হয়। সেই সময় থেকেই এই ‘মহিলা কমিশন’ নারীর অধিকারের বিষয়ে কিছু কাজ করে আসছে। বলা বাহুল্য রাষ্ট্রসংঘের বা তার মহিলা কমিশনের কাজগুলি নেহাৎই মামুলি ও আনুষ্ঠানিক পর্যায়ে হয়ে থাকে। রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদে বিভিন্ন সময়ে এই মহিলা কমিশনের রিপোর্ট ও সুপারিশগুলি নিয়ে আলোচনাও করা হয়েছে এবং নারীর সমান অধিকার সুরক্ষিত করার বিষয়ে বিশেষ কয়েকটি ঘোষণাও করা হয়েছে। রাষ্ট্রসংঘের আন্তর্জাতিক মহিলা কমিশনের কাজকর্মে একটা স্বীকৃতি হিসাবে এবং নারীর অধিকার ও মর্যাদার উন্নতি সাধনের প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার লক্ষ্য ঘোষণা করেই রাষ্ট্রসংঘ ১৯৭৫ সালটিকে আন্তর্জাতিক নারীবর্ষ হিসাবে চিহ্নিত করেছে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে বিগত ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে বিশ্ব নারীসংঘের (WIDF) পক্ষ থেকে রাষ্ট্রসংঘের কাছে সুপারিশ করা হয় যে, আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতে নারীদের সমস্যাবলী আলোচনার জন্য একটি ‘নারীবর্ষ’ ঘোষণা করা হোক। এখানে উল্লেখ্য যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এক একটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য রাষ্ট্রসংঘ থেকে সম্প্রতি এক একটি বৎসরকে চিহ্নিত করা হচ্ছে। বিগত ১৯৭৪ সাল ছিল ‘আন্তর্জাতিক জনসংখ্যা বৎসর’। রাষ্ট্রসংঘের মহিলা কমিশন রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদের কাছে বিশ্বনারী সংঘের সুপারিশটি পেশ করে। অবশেষে ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রসংঘের ২৭তম সাধারণ পরিষদে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে ১৯৭৫ সালটিকে ‘আন্তর্জাতিক নারীবর্ষ’ বলে চিহ্নিত করা হয়। এবং নারীসমাজের বিশেষ সমস্যাগুলির প্রতি সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্দেশ্যের কথা বলা হয়। এই প্রসঙ্গে প্রকাশিত রাষ্ট্রসংঘের বিশেষ ম্যানিফেস্টোতে নারীদের উন্নতির জন্য প্রধানত তিনটি বিষয়ের উপর জোর দেওয়া হয়েছে: শান্তি, সংহতি ও সমানাধিকার (Equality, Integration in social, econominic and political life and Maintaining peace)। এই আন্তর্জাতিক নারীবর্ষের জন্য একটি প্রতীকও গ্রহণ করা হয়। এতে শান্তির প্রতীক হিসাবে রয়েছে, বনকপোত, ব্লুশ, সমতার আঙ্কিক চিহ্ন। আন্তর্জাতিক নারীবর্ষের ঘোষিত উদ্দেশ্য সফল করার জন্য যেসব সাময়িক এবং দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচীর কথা ঘোষণা করা হয়েছে তার মধ্যে আছে পৃথিবীর সকল দেশে যথাযোগ্য প্রয়োজনীয় আইন পাস করে নারীজীীতির সমমর্যাদার অধিকার সুনিশ্চিত করা, দেশে দেশে শিশুমঙ্গল প্রতিষ্ঠানসমূহ বেশি সংখ্যায় নির্মাণ করা, নারীদের জন্য সামাজিক কাজকর্মের ক্ষেত্রকে ব্যাপক ও উন্নত করা, সামাজিক উন্নয়নে নারীদের অবদানের বিষয়বস্তু নিয়ে রাষ্ট্রসংঘের সদর দপ্তরে এই বৎসর ৮ মার্চ একটি আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী উদ্বোধন করা, ১৯৭৫ সালের মধ্যে একটি আন্তর্জাতিক মহিলা সম্মেলনের ব্যবস্থা করা, শান্তির সংগ্রামে নারীদের ভূমিকা আলোচনার জন্য একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন ডাকা প্রভৃতি। সেই কর্মসূচী অনুযায়ী বিগত ১৯ জুন-২ জুলাই ‘৭৫ লাতিন আমেরিকার মেক্সিকোতে আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনের আহ্বান করা হয়। আবার অক্টোবর মাসে পূর্ব জার্মানির বার্লিনেও বিশ্বনারী সংঘ, বিভিন্ন দেশের আরো কয়েকটি মহিলা সংগঠন ও শ্রমিক সংগঠন প্রভৃতি বে-সরকারী সংগঠনগুলির উদ্যোগে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আহ্বান করা হয়। এই সম্মেলন থেকে একটি ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। এই ঘোষণার নামকরণ করা হয় “নারীদের সম অধিকার এবং উন্নয়ন ও শান্তির ক্ষেত্রে তাদের অবদান সম্বন্ধে ১৯৭৫ সালের মেক্সিকো ঘোষণা।” সংক্ষেপে বলা হয় মেক্সিকো ঘোষণা।
উক্ত ঘোষণায় বলা হয় নারীদের কাজ করার অধিকার থাকবে, সমান কাজের জন্য সমান মজুরি দিতে হবে, নারীদের কাজের জন্য সমান সুযোগ দিতে হবে, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পুনর্বিন্যাসের বর্তমান সময়ে নারীদের বিভিন্ন অধিকারের
নীতিগুলি কার্যকরী করতে হবে; জাতীয় অর্থনৈতিক সামাজিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের প্রধান ধারার সহিত নারীদের আরও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হবার সুযোগ দিতে হবে ইত্যাদি। মেক্সিকো ঘোষণার উপসংহারে বলা হয় এই ঘোষণায় যে সব উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের কথা বলা হয়েছে সে সকল সফল হতে পারে এমন এক পৃথিবীতে যেখানে রাষ্ট্র ও সরকারগুলির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের এই নীতিগুলি মেনে চলা হবে, রাষ্ট্রগুলির সার্বভৌম সম অধিকার, জাতিগুলির অবাধ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, কোন দেশের অঞ্চল জোর করে অধিকার না করা কিংবা জোর করে অধিকৃত হলেও তা মেনে না নেওয়া, আঞ্চলিক অখণ্ডতা, অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করা ইত্যাদি।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে রাষ্ট্রসংঘ ঘোষিত নারীবর্ষ ১৯৭৫ সালটি শেষ হয়ে গেল। ইতিমধ্যে রাষ্ট্রসংঘ থেকে আবার ১৯৭৬-৮৬ এই দশ বর্ষকে ‘আন্তর্জাতিক নারী দশক’ বা International Women’s Decade ঘোষণা করার কথা বলা হয়েছে।
বলা বাহুল্য রাষ্ট্রসংঘের পক্ষ থেকে এই যে নারীবর্ষ বা নারীর অধিকার রক্ষার কথা ঘোষণা করা হয়েছে তা ধনতান্ত্রিক দুনিয়ার শাসকশ্রেণীও বিশেষ আগ্রহের সঙ্গে প্রচার করেছে। সোভিয়েত রাশিয়া এবং অন্যান্য কয়েকটি সমাজতান্ত্রিক দেশ ও অন্যান্য দেশেও বিশেষ করে বিশ্ব নারী সংঘের শাখাগুলির উদ্যোগে এই নারীবর্ষ বেশ সমারোহের সঙ্গে পালন করা হয়েছে। ভারতবর্ষও আগ্রহ দেখিয়েছে। ভারত সরকার এই বর্ষটিকে ‘যথাযোগ্য মর্যাদার’ সঙ্গে উদ্যাপন করার সংকল্প ঘোষণা করেছে এবং সেই অনুযায়ী একটি ‘জাতীয় কমিটি’ গঠন করেছে। এই কমিটির কর্মসূচীর মধ্যে আছে আশু এবং দীর্ঘমেয়াদী কিছু কর্মসূচীর তালিকা। তাছাড়া বহু বেসরকারী প্রতিষ্ঠানও এই নারীবর্ষ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্যে পালন করেছে। তবে রাষ্ট্রসঙ্ঘের উদ্যোগে এই ‘আন্তর্জাতিক নারীবর্ষ পালন মূলত শুধু আনুষ্ঠানিক পর্যায়েই থেকে যাচ্ছে এবং যথারীতি বহুারন্তে লঘুক্রিয়ায় পরিণত হচ্ছে। রাষ্ট্রসংঘের উদ্যোগে আন্তর্জাতিকভাবে সমাজে সর্বক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও মর্যাদার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির যথেষ্ট গুরুত্ব আছে সন্দেহ নাই। তবে এই উপলক্ষে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সমাজব্যবস্থার বিশ্লেষণ করে তুলে ধরা প্রয়োজন। আমরা পূর্বেই এ আলোচনা করেছি। সমাজের মানুষের মধ্যে শোষক শোষিতের শ্রেণীভেদ বজায় থাকলে শোষিত নারী সমাজের প্রকৃত মুক্তি আসা বা বাস্তবক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ নারীসমাজের প্রকৃত সমান অধিকার বা মুক্তির প্রশ্নটিকে মূলত এই দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই দেখতে হবে। তাই আমরা লক্ষ্য করি যে এই বহুল প্রচারিত আন্তর্জাতিক নারীবর্ষ-এর কথা যতই উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করা হোক না কেন, একমাত্র সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি ছাড়া অন্য কোথাও দেশের ব্যাপক নারী সমাজের প্রকৃত সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারছে না, মূলত শোষিত নারীসমাজের অবস্থার পরিবর্তন আসছে না।
এই প্রসঙ্গে আবার আমাদের সেই গোড়ার কথাটা স্মরণ করা প্রয়োজন যে, মানব সমাজে শ্রেণী শোষণের সূচনা থেকে বিশ্বের দেশে দেশে নারী জাতি শোষিত হয়ে আসছে, পারিবারিক জীবনে পুরুষের পরাধীনতা ও দাসত্বের জীবন-যাপন করে আসছে। লেনিন দেখিয়েছেন ধনতন্ত্রের আমলে নারীজাতি শোষিত হচ্ছে দ্বিগুণভাবে। একে তো শ্রমিক কৃষক নারীরা শোষিত শ্রেণীর অংশ হিসাবে শোষিত হয়, তদুপরি এমনকি সবচেয়ে গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া রিপাবলিকেও তারা প্রথমত আইনের চোখে পুরুষের তুলনায় হীন অবস্থায় থাকে, দ্বিতীয়ত তারা পারিবারিক দাসত্বের মধ্যে থাকে।
শ্রেণীবিভক্ত সমাজে সামন্ততান্ত্রিক-ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক কাঠামো থাকার দরুন এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পরিবারগুলিই সমাজের অর্থনৈতিক অণুকেন্দ্র (economic unit) হয়ে থাকার দরুন, ব্যাপকভাবে নারীদের সামাজিক উৎপাদনের কাজে যোগ দেবার কোন সুযোগ-সুবিধা থাকে না। আর তারা অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও পেতে পারে না। তাই শ্রেণীবিভক্ত সামন্ততান্ত্রিক-ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীর সমানাধিকার বা পুরুষের সমান সামাজিক মর্যাদা কখনই সর্বসাধারণ নারীদের জন্য হতে পারে না। সেখানে নারীদের জন্য শিক্ষা, জীবিকা, আইন-কানুনের সুযোগ সুবিধা প্রভৃতির জন্য যা কিছু ব্যবস্থাই হয়ে থাক না কেন, ব্যাপক নারীসমাজের মাত্র একটা ক্ষুদ্র অংশই শুধু অত্যন্ত সীমিতভাবে তা ভোগ করতে পারে। একমাত্র শ্রেণীহীন শোষণহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলেই সর্বসাধারণ নারীদের জন্য সমান অধিকারের পূর্ণ সুযোগ সুবিধা মিলতে পারে।
আজ যখন রাষ্ট্রসংঘ ঘোষিত ‘আন্তর্জাতিক নারীবর্ষ’র ডামাডোলের মধ্যে ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্রান্স, ইটালী, পশ্চিম ও পূর্ব জার্মানি, ভারতবর্ষ, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, এশিয়া আফ্রিকার আরো নানা দেশ সোভিয়েত রাশিয়া ও তার সহযোগী সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির সরকারী ও বেসরকারী সংগঠনগুলি একই সঙ্গে নারীর সমান অধিকার বা নারীমুক্তির কথা বলছে, তখন আমাদের আরো বেশি সতর্ক থাকা দরকার যাতে নারীর অধিকার বা নারীমুক্তির আন্দোলন সম্বন্ধে আমাদের বৈপ্লবিক শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গি আচ্ছন্ন হয়ে না হয়ে যায়। আমাদের মনে রাখতে হবে যে যখন ১৯৭৫ সালে ‘আন্তর্জাতিক নারীবর্ষ’ উদ্যাপিত হচ্ছে তখন ইতিমধ্যে সোভিয়েত রাশিয়ার পর মহাচীন এবং ইউরোপ এশিয়ার আরো কয়েকটি দেশে ও আমেরিকা ভূখন্ডের কিউবায় তথা পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে এবং সেখানে নারীর সমান অধিকার ও পূর্ণমুক্তি বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। সে সব সমাজতান্ত্রিক দেশে বহুযুগের শোষিত-নিপীড়িত নারীসমাজ সর্বপ্রকার সামাজিক শোষণ ও বৈষম্যমূলক আচরণের অবমাননা ও গ্লানি থেকে মুক্তিলাভ করেছে। আর তারই পাশাপাশি পৃথিবীর আরো দুই তৃতীয়াংশে সামন্ততান্ত্রিক ধনতান্ত্রিক শ্রেণীবিভক্ত সমাজে নারীজাতি নানাভাবে শোষিত হচ্ছে। তাদের সমস্যা এখন মূলত সমাজের আমূল পরিবর্তনের সমস্যা। আর সে সমস্যা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে সমস্ত শোষিত জনগণের মুক্তির সমস্যার সঙ্গে। তাই আজ আন্তর্জাতিক নারীবর্ষের কথা বলতে গেলে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির মুক্ত নারীসমাজের অবস্থা আর সামন্ততান্ত্রিক-ধনতান্ত্রিক দেশগুলির শ্রেণীবিভক্ত সমাজের শোষিত-বঞ্চিত নারীসমাজের কথা কখনও একসঙ্গে গুলিয়ে মিলিয়ে বললে চলবে না। নারীর সমান অধিকারের মৌলিক সমস্যার কথা এড়িয়ে গিয়ে উপর উপর ‘অধিকার’, ‘নারীর উন্নতি’ নিয়ে ঢাকঢোল বাজানোর মধ্যে বুর্জোয়াদের যে একটা শঠতা আছে, মানুষকে বিভ্রান্ত করবার যে একটা চাতুর্য আছে তা বোঝা দরকার। তাই ‘আন্তর্জাতিক নারীবর্ষ উপলক্ষে বিভিন্ন দেশে নারীসমাজের প্রকৃত অবস্থার বিশ্লেষণ করে, শোষিত নারীসমাজের প্রকৃত মুক্তির মুখ্য প্রশ্নটিকে তুলে ধরা আমাদের প্রয়োজন। মার্কসবাদী বিশ্লেষণ অনুযায়ী বৈপ্লবিক শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই সব অবস্থাটা বিচার করে দেখতে হবে।
আরো একটা কথা আমাদের বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার। ঊনবিংশ শতাব্দীর বুর্জোয়া নবজাগরণের সময় বিভিন্ন দেশে বুর্জোয়া শ্রেণীর যে প্রগতিশীল ভূমিকা ছিল, এখন আর তা নাই। এক শতাব্দী পূর্বে নারীর ভোটাধিকার, শিক্ষা-জীবিকার অধিকার, সীমাবদ্ধভাবে সামাজিক অধিকারের জন্য বুর্জোয়ারা যেটুকু প্রগতিশীল কাজ করতে পেরেছিল, আজ আর ক্ষয়িষ্ণু ধনতান্ত্রিক সমাজের বুর্জোয়ারা তা করতে পারে না। আর আজকের দিনের প্রয়োজনও অনেক এগিয়ে গেছে। আজ শুধু মুখে মুখে বা আইনগতভাবে নারীর সমান অধিকার মেনে নেওয়াটা এমন কোনো প্রগতিশীল কথাই নয়, সে যুগ আমরা পেরিয়ে এসেছি। এখন প্রয়োজন সমাজের আমূল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নারীর আইনগত স্বীকৃত অধিকারকে সর্বসাধারণের ক্ষেত্রে কার্যকরী করে তোলা। সে জিনিস বুর্জোয়াদের দ্বারা সম্ভব নয়। শুধু তাই নয়, ধনতন্ত্র এখন আর কোনো প্রগতিশীল ভূমিকাই পালন করতে পারছে না। ধনতন্ত্র এখন ক্ষয়িষ্ণু, তার ভূমিকা এখন প্রতিক্রিয়াশীল। প্রগতি জিনিসটা স্থান কাল পাত্র হিসাবে আপেক্ষিক। এক সময় সামন্ততন্ত্রের রক্ষণশীল সভ্যতার বিরুদ্ধে বুর্জোয়া সভ্যতা হয়ে উঠেছিল প্রগতিশীল। কিন্তু এখন বুর্জোয়া সভ্যতা সংস্কৃতি ক্ষয়িষ্ণু, প্রতিক্রিয়াশীল। এখন বুর্জোয়াদের হাত থেকে ‘গণতন্ত্রের পতাকা’ ধূলায় লুন্ঠিত হয়েছে। ধনতন্ত্রের চরম সংকটের যুগে এখন মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে তারা। বিশ্ব সভ্যতা এখন এগিয়ে চলেছে সমাজতন্ত্রের দিকে। এখন বুর্জোয়াদের হাত দিয়ে সমাজের আর অগ্রগতি হতে পারছে না। তাই নারীসমাজের সমান অধিকার বা মুক্তির জন্যও তারা বেশি কিছু করতে পারছে না। উপরন্তু তাদের গাল ভরা কথা, প্রচার ও নানা রকম আনুষ্ঠানিক কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে প্রকৃত সত্যকে আচ্ছন্ন করে রাখছে, শঠতার আশ্রয় নিয়ে মোহ বিস্তার করছে। এখন নারীসমাজের জন্য উন্নতি বা প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করতে হলে সমাজের মৌলিক পরিবর্তন চাই। সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন চাই। নারীসমাজকে ব্যাপকভাবে সামাজিক উৎপাদনের কাজের মধ্যে নিয়ে এসে তাদের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বনের পথ মুক্ত করে দেওয়া চাই। কিন্তু ধনতান্ত্রিক বা সামন্ততান্ত্রিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় তা করা সম্ভব নয়। যেমন সম্ভব নয় এই শ্রেণীবিভক্ত সমাজে শ্রমিক কৃষক ও শোষিত জনগণের মৌলিক সমস্যার কোনো সমাধান করা, ঠিক তেমনই শোষিত জনগণের একাংশ শোষিত নারী সমাজেরও সমস্যার কোনো মৌলিক সমাধান এই সমাজ ব্যবস্থায় সম্ভব নয়। শুধু তাই নয়, এখন বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে লড়াই না করে, ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই না করে সমাজ প্রগতির পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। নারী আন্দোলনের ক্ষেত্রেও আমরা তাই দেখতে পাই যে প্রতিক্রিয়াশীল ধনিকদের সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম না করে আর নারী প্রগতির পথে অগ্রসর হওয়া যায় না। কারণ সামন্ততান্ত্রিক-ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাই নারীর অগ্রগতির পথ রুদ্ধ করে আছে, আর সেই ব্যবস্থারই রক্ষক হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী সামন্ততান্ত্রিক দেশের ধনিকগোষ্ঠীর সরকারগুলি।
আন্তর্জাতিক নারী আন্দোলনের ধারাকে বুঝতে হলে বিশ্বের রাজনৈতিক পটভূমিকার পরিবর্তনের কথা মনে রাখা দরকার। মনে রাখা দরকার যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে রাশিয়ায় ১৯১৭ সালের নভেম্বর বিপ্লবের পর মানব ইতিহাসের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছিল। তখন থেকেই আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক শক্তিগুলির ভারসাম্য সমাজতন্ত্র ও জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে স্পষ্টতই এসে গেল। সমাজতন্ত্র তখন আর শুধু মানুষের ধ্যান-ধারণা বিশ্বাসের বিষয়ই রইল না, প্রত্যক্ষ বাস্তব অভিজ্ঞতায় বিষয় হয়ে গেল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নিপীড়িত মানুষ নতুন চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিসংগ্রামের পথে অগ্রসর হতে থাকল। তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিস্ত চক্রের পরাজয়ের পর বিগত তিন দশক ধরে বিভিন্ন দেশে সমাজতন্ত্রের ও জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের জয়যাত্রা অব্যাহতভাবে এগিয়ে চলেছে। মহাচীনে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। লাতিন আমেরিকার কিউবায় বিপ্লবের বিজয়ের পর সেখানে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিগত তিন দশকে এশিয়া মহাদেশের বিপুল অগ্রগতি হয়েছে। ব্রিটিশ, ফরাসী ও ওলন্দাজ সাম্রাজ্যবাদীরা ভারত ও অন্যান্য দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছে। পাকিস্তানের আয়ুবশাহির কবল থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা পর্যুদস্ত হয়েছে কোরিয়া, ভিয়েতনাম, কাম্বোডিয়া, লাওসে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের বর্বর আক্রমণের বিরুদ্ধে কাম্বোডিয়া ভিয়েতনামের জনগণের যুগান্তকারী বিজয় সমগ্র বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষকে বিপুল উৎসাহ ও আত্মবিশ্বাস দিয়েছে। আইসল্যান্ড, ফিলিপাইন পর্যন্ত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের হাতছাড়া হতে চলেছে। পশ্চিম এশিয়ার আরব দেশগুলি ঐক্যবদ্ধ হয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্তের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে চলেছে। প্রশান্ত মহাসাগরের অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড পর্যন্ত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে চলেছে। আফ্রিকা মহাদেশে স্বাধীনতা আন্দোলনের যুগান্তকারী ইতিহাস রচিত হয়েছে- একটির পর একটি দেশ ঔপনিবেশিক দাসত্ব থেকে স্বাধীনতা লাভ করে চলেছে। মোজাম্বিক, গিনি বিসাউ, অ্যাঙ্গোলার মতো পাঁচশত বছরের পর্তুগীজ উপনিবেশগুলি স্বাধীনতা লাভকরেছে। খাস ইউরোপেও জনগণের অগ্রগতি দ্রুত এগিয়ে চলেছে। পর্তুগালে ফ্যাসিস্ত একনায়কত্বের অবসান হয়েছে, গ্রীসে নাগরিক শাসনব্যবস্থা কায়েম হয়েছে। ফ্রান্স ইতালীর অবস্থাও পরিবর্তন হয়েছে। সর্বত্রই ফ্যাসিস্ত ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির পরাজয়ের পর ইতিহাস বিগত তিন দশকে উজ্জ্বলতর হয়েছে। এমনকি সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর পাণ্ডা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের নিজ দেশের অভ্যন্তরেও জনগণের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম বিপুলভাবে এগিয়ে গেছে। ভিয়েতনামে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের আক্রমণের বিরুদ্ধে আমেরিকার জনগণ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছে। ওদিকে সাম্রাজ্যবাদীরা আজ নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য বেপরোয়াভাবে লেগে গেছে। স্বাধীন দেশগুলিতেও যাতে সর্বহারা শ্রেণীর অগ্রগতিকে দমন করে রাখা যায়, যাতে সমাজতন্ত্রের পথ রুদ্ধ করে রাখা যায় তার জন্য সে সব দেশের বুর্জোয়াশ্রেণীও তার সরকারকে নানাভাবে মদত দিচ্ছে, নানাভাবে সে সব দেশের জনগণের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে। অবক্ষয়ী প্রতিক্রিয়াশীল ধনতন্ত্র সমাজতন্ত্রের অগ্রগতিকে রুখবার জন্য মরিয়া হয়ে লেগে গেছে, বিপ্লবী সর্বহারা শ্রেণীর উপর চরম আঘাত হানছে। বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অনৈক্যকেও তারা নানাভাবে ধনতান্ত্রিক ও সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে ব্যবহার করবার জন্য কুটিল চক্রান্ত করে চলেছে। কিন্তু তবুও অবিসংবাদীভাবেই বিশ্বব্যাপী সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে সমাজতন্ত্রের দিকে শোষিত জনগণের অগ্রগতি অব্যাহত রয়েছে। আর তারই সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে চলেছে শোষিত নারীসমাজের মুক্তির সংগ্রাম। বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে স্পষ্টই দেখা যায় দেশে দেশে সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম পরাধীন ঔপনিবেশিক দেশে জাতীয় মুক্তির জন্য বা স্বাধীন দেশগুলিতে শোষিত জনগণের জীবন-জীবিকা গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য যে রাজনৈতিক সংগ্রাম চলেছে তার মধ্যে সব দেশেই শোষিত নারীসমাজ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে চলেছে।
আমাদের সামনে রয়েছে সোভিয়েত, চীন ও ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির সংগ্রামী নারীদের ঐতিহাসিক বীরত্বের আদর্শ, পরবর্তী সময়ে ভিয়েতনামের বীর নারীদের মহান আদর্শ, কিউবার ও কোরিয়ার বিপ্লবী নারীদের আদর্শ, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলিতে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী নারীদের আদর্শ। সর্বত্রই আমরা দেখেছি যে দেশের জনগণের রাজনৈতিক আন্দোলনের ধারার সঙ্গে যুক্ত হয়েই এগিয়ে চলেছে শোষিত-নিপীড়িত নারীসমাজের উন্নতি ও সামাজিক মুক্তির আন্দোলন। জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষার সংগ্রাম বা দেশের অভ্যন্তরে জনগণের জীবন-জীবিকা, গণতান্ত্রিক অধিকারের সংগ্রাম এগুলি থেকে বিচ্ছিন্নভাবে আর নারী প্রগতির কোনো আন্দোলন এগোতে পারে না। আজকের দিনে উপর উপর বুর্জোয়া সংস্কারবাদের মধ্য দিয়ে আর কোনো প্রকৃতপক্ষে প্রগতিশীল নারী আন্দোলন হতে পারে না। মূলত শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে এবং শ্রেণীহীন শোষণহীন সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য মনে রেখেই প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক নারী আন্দোলন এগোতে পারে। আর সে আন্দোলন ধনিকশ্রেণীর সরকারের বিরুদ্ধেই যাবে। এই শ্রেণীসংগ্রামের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত না হলে, শ্রেণী চেতনার আলোকে উদ্বুদ্ধ না হলে প্রকৃত গণতান্ত্রিক নারী আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে না। গণতান্ত্রিক নারী আন্দোলনের কোন্ শ্রেণীর স্বার্থে কোন্ শ্রেণীর বিরুদ্ধে তা বোঝা দরকার। শ্রমিক কৃষক মধ্যবিত্ত শোষিত নিপীড়িত ব্যাপক নারীসমাজকে ব্যাপক গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্যে আনতে গেলে নারীর সমান অধিকার ও নারী মুক্তি আন্দোলনের মধ্যে আনতে গেলে, এই মূল প্রশ্নটির সুষ্ঠু বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
এখন এই বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে যখন বিশ্বের এক তৃতীয়াংশে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে, সেখানে নারীসমাজের পূর্ণ মুক্তি সাধিত হয়ে গেছে, তখন আর বুর্জোয়া পার্লামেন্টগুলিতে বা রাষ্ট্রসংঘ থেকে শুধু নারী পুরুষের সমান অধিকারের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির বা নারীর জীবিকা অর্জনের প্রয়োজনীয়তার স্বীকৃতির মধ্যে কোনও বৈপ্লবিক তাৎপর্য নাই, বা কোন এমন প্রগতির সূচনা করে না। এখন প্রশ্ন কিভাবে শ্রমিক কৃষক মধ্যবিত্ত মেহনতী শোষিত জনগণের সঙ্গে ব্যাপক নারীসমাজকে সামাজিক উৎপাদনের কাজের মধ্যে টেনে এনে তাদের প্রকৃত মুক্তির পথ খুলে দেওয়া যায়, কিভাবে সমাজের মূল অর্থনৈতিক কাঠামোর বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করে প্রকৃত সমাজতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হওয়া যায়, যাতে শোষিত নারীসমাজের প্রকৃত মুক্তি আসতে পারে। সেই শোষণহীন শ্রেণীহীন সমাজতন্ত্রের পথে যেতে হলে যে দেশে যে যে অন্তর্বর্তী ধাপ উত্তীর্ণ হতে হবে তার প্রত্যেকটি সংগ্রামের সঙ্গে শোষিত নারীসমাজের সমান অধিকার বা মুক্তির সংগ্রামকে যুক্ত করতে হবে তা সে পরাধীন দেশের জাতীয় মুক্তির সংগ্রামই হোক আর স্বাধীন দেশের ধনিক সরকারের বিরুদ্ধে শোষিত জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারের সংগ্রামই হোক আর জনগণের এই সংগ্রামগুলি সাধিত হবে শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে ক্ষয়িষ্ণু বুর্জোয়া শ্রেণীর দ্বারা জাতীয় আন্দোলনের আর কোন প্রগতিশীল অগ্রগতি হতে পারছে না তা মনে রাখা দরকার। উল্লেখ করা যেতে পারে যে এই প্রসঙ্গেই সোভিয়েত রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির ১৯তম কংগ্রেসে স্তালিন বলেছিলেন:
“পূর্বে বুর্জোয়ারাই দেশের নেতা বলে পরিগণিত হতো, তারা দেশের অধিকার ও স্বাধীনতাকে সবার উচ্চে স্থান দিয়েছিল। এখন আর সেই জাতীয় নীতির লেশমাত্র নাই। এখন বুর্জোয়ারা দেশের অধিকার ও স্বাধীনতাকে ডলারের বিনিময়ে বিক্রি করে দেয়। তারা জাতীয় স্বাধীনতা ও জাতীয় সার্বভৌমত্বের পতাকাকে ফেলে দিয়েছে।
সন্দেহ নাই যে এখন আপনারা যদি দেশপ্রেমিক হতে চান, যদি দেশের প্রধান শক্তি হিসাবে কাজ করতে চান, তবে আপনাদেরই, কমিউনিস্ট ও গণতান্ত্রিক পার্টিগুলির প্রতিনিধিদেরই সেই পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরে এগিয়ে যেতে হবে। সেই পতাকা তুলে ধরবার আর কেউ নেই।” [Formerly, the bourgeoisie was regarded as the head of the nation; it upheld the rights and independence of the nation and placed them ‘above all else’. Now not as trace remains of the ‘national principle’. Now the bourgeoisie sells the rights and independence of the nation for dollars. The banner of national independence and national sovereignty has been thrown overland. There is no doubt that it is you, the representatives of the communist and democratic parties, who will have to raise this banner and carry it forward if you want to be partriots of your country, if you want to become the leading force of the nation. There is nobody else to raise it.” - Stalin’s speech, 19th Congress of the CPSU]
স্তালিনের এই বিশ্লেষণের ২৪ বৎসর অতীত হয়েছে। বিশ্বের শোষিত জনগণের অগ্রগতি বহু যোজন এগিয়েছে এবং বুর্জোয়াদের সংকটও বহুগুণ বেড়েছে। তারা যখন জাতীয় মুক্তির পতাকা হাত থেকে ফেলে দিয়েছে, গণতন্ত্রের পতাকা ফেলে দিয়েছে তখন তারা আর কেমন করে নারীমুক্তির পতাকা তুলে ধরবে? এই সহজ কথাটা আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় উভয় ক্ষেত্রেই সত্য। নারীমুক্তির পতাকা তুলে ধরেছে দেশে দেশে শ্রমিকশ্রেণী, শোষিত-নিপীড়িত সংগ্রামী গণতান্ত্রিক জনগণ। শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে শোষিত জনগণের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়েই এগিয়ে যাবে শোষিত নারীসমাজের সমান অধিকার বা মুক্তির আন্দোলন। মার্কসবাদী তত্ত্বের এই বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ আমাদের মনে রাখা দরকার। আমাদের মনে রাখা দরকার যে ধনতন্ত্রের বিকাশের সময় ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থাই সামাজিক উৎপাদনের কাজের মধ্যে নারীসমাজের একাংশকে টেনে এনে তাদের সামাজিক মুক্তির পথ খুলে দিল। কিন্তু এখন ধনতন্ত্রের পতন এবং সমাজতন্ত্রের অগ্রগতির সময়ে ধনতন্ত্রই আবার নারীমুক্তির আরো অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামাজিক উৎপাদন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ছাড়া সমাজের অগ্রগতি হতে পারছে না। উল্লেখ করা যেতে পারে যে ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্রান্সের মতো বড় বড় ধনতান্ত্রিক দেশেও নারীদের মধ্যে কাজের জন্য, সমান কাজে সমান মজুরির জন্য শ্রমজীবী নারীদের মধ্যে ব্যাপক আন্দোলন হচ্ছে। ঐশ্বর্যের পাহাড়ের উপর বসেও তারা বেকার সমস্যার সমাধান করতে পারছে না। নারীর পতিতাবৃত্তির অবসান করতে পারছে না, সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে নারীর অবমাননা দূর করতে পারছে না তাদের পক্ষে তা পারা সম্ভব নয়। অথচ চীন রাশিয়া থেকে শুরু করে কিউবা কোরিয়া পর্যন্ত ছোট বড় প্রত্যেকটি সমাজতান্ত্রিক দেশেই নারীদের বেকার সমস্যা দূর হয়েছে এবং সমান কাজে সমান মজুরির নীতি কার্যকরী হয়েছে। পতিতাবৃত্তির অবসান হয়েছে। সমাজের মূল অর্থনৈতিক কাঠামোর বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জন্য তা সম্ভব হয়েছে।
এই বৈপ্লবিক চেতনা ছাড়া বর্তমানে প্রগতিশীল নারী আন্দোলনের অগ্রগতি সম্ভব নয়। বিভিন্ন দেশের অবস্থার প্রকারভেদ থাকলেও আন্তর্জাতিক নারী আন্দোলনের কথা আলোচনা করতে গেলে এই মূল কথাগুলি মনে রাখতে হবে। নারী আন্দোলনের এই বৈপ্লবিক ভূমিকার কথা লেনিন ১৯১৭ সালেই ‘সর্বহারার রণনীতির’ মধ্যে উল্লেখ করে বলেছেন: “প্যারি কমিউন প্রসঙ্গে জনৈক বুর্জোয়া সমালোচক একটি ইংরাজী সংবাদপত্রে লিখেছেন ফরাসী জাতির সকলেই যদি নারী হতো সে কি ভয়ঙ্কর জাতিই না হতো! তের বৎসর ও তদুর্ধ্বের নারী ও শিশুরা প্যারি কমিউনের সময় পুরুষের পাশাপাশি লড়াই করেছে। আগামীদিনের বুর্জোয়াদের পতন ঘটানোর লড়াইয়েও তার অন্যথা হবে না। অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত বুর্জোয়ারা যখন সামান্য অস্ত্রহাতে অথবা নিরস্ত্র শ্রমিকদের গুলি করে মারতে থাকবে, তখন সর্বহারা শ্রেণীর নারীরা নিষ্ক্রিয় দর্শক হয়ে থাকবে না। ১৮৭১ সালে তারা যেমন অস্ত্র ধারণ করেছিল তেমনই করবে এবং আজকের দিনের দেশের এই স্তিমিত অবস্থায় থেকে আরো সঠিকভাবে বলতে গেলে, বর্তমানের শ্রমিক আন্দোলনের এই অবস্থা থেকে, যেখানে কিনা সরকার অপেক্ষাও সুবিধাবাদীরাই অধিক বিশৃঙ্খলা এনে দিচ্ছে তার থেকে আজই হোক আর কালই হোক, নিঃসন্দেহে এবং নিশ্চিতভাবেই তারা মাথা তুলে দাঁড়াবে এবং বিপ্লবী সর্বহারাদের সেই ‘ভয়ঙ্কর জাতি’দের আন্তর্জাতিক সংঘ গড়ে উঠবে।” [“A certain bourgeois observer of Paris Commune, writing to an English newspaper said: If the French nation consisted entirely of women, what a terrible nation it would be! ‘women and children of thirteen and upwards, fought in the Paris Commune side by side with the men. Nor can it be different in the forthcoming battles for the overthrow of the bourgeois. The proletarian women will not look on passively while the wellarmed bourgeois shoot down their poorly armed or unarmed workers. They will take to arms as they did in 1871, and from the cowed nation of today - or more correctly, from the present day labour movement which is disorganised more by the opportunists that by the goverments - there will undoubtedly arise, sooner or lated but with absolute certainly, and international league of the terrible nation’s of the revolutionary proletariate. - Lenin: War Programme of The Proletarian Revolution, Sept. 1917].
লেনিন এইভাবে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শোষিত নারীসমাজের সংহতি ও সংগঠনের কথা বলেছিলেন। তিনি চিন্তা করেছিলেন প্যারি কমিউনের সময়কার সেই বীরঙ্গনাদের মতো সর্বহারা নারীরা মাথা তুলে দাঁড়াবে, এগিয়ে আসবে আর গড়ে উঠবে ‘an international league of the terrible nations’ of the revolutionary proletariat. সেই পথেই শুরু হয়েছিল সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী আন্দোলন, সংগঠিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী নারী সম্মেলন, প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের বৈপ্লবিক ঐতিহ্য, সূচনা হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বে আর্ন্তজাতিক নারী আন্দোলন ও সংগঠন বিশ্ব নারী সংঘ। কিন্তু পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে যে বিশ্বসমাজতান্ত্রিক শিবিরের অনৈক্য মতপার্থক্যর মধ্যে পড়ে বিশ্বনারী সংঘ আমাদের সে বৈপ্লবিক প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না, আর শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বেও এখনো কোনো আন্তর্জাতিক নারী আন্দোলন ও সংগঠন গড়ে উঠতেও পারছে না, যদিও বিভিন্ন দেশে শ্রমজীবী নারীদের আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক নারী আন্দোলন অভূতপূর্ব বৈপ্লবিক ভূমিকা গ্রহণ করছে। কিন্তু সর্বহারা আন্তর্জাতিকতার বৈপ্লবিক ভূমিকার অঙ্গ হিসাবেই শোষিত নারীসমাজের পূর্ণ মুক্তির আন্দোলনের আন্তর্জাতিক ভূমিকার প্রত্যাশা আমাদের পূরণ হয়নি। মার্কসবাদের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের উপর ভিত্তি করেই লেনিন বলেছেন “যতক্ষণ না শোষিত নারীজাতির জন্য পূর্ণমুক্তি আনতে পারে ততক্ষণ সর্বহারা তার পূর্ণমুক্তি পেতে পারে না।” [“The Proletariat cannot achieve complete freedom unless it achieves complete freedom for women. – Lenin, Feb, 21, 1920.] সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও ব্যাপক গণতান্ত্রিক নারী আন্দোলন যা কিনা প্রকৃতই নারীদের সমান অধিকার ও মুক্তির আন্দোলন হতে পারে- এগিয়ে চলবে। এবং বৈপ্লবিক শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই আমাদের আন্তর্জাতিক নারী আন্দোলনের প্রশ্নটিকে বুঝতে হবে। বুঝতে হবে যে যদি আন্তর্জাতিক সর্বহারা শ্রেণীর আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে না চলে, যদি বিশ্বসমাজতন্ত্রের পথে, বিশ্বের শোষিত শ্রমজীবী জনগণের সংগ্রামের সঙ্গে সারা বিশ্বের শোষিত নারীসমাজের মুক্তির সংগ্রাম একসঙ্গে না আসে তবে আমরা আন্তর্জাতিক নারী আন্দোলনের মূল বৈপ্লবিক ভিত্তিই হারিয়ে ফেলব। শোষিত নিপীড়িত নারীসমাজের কাছে আন্তর্জাতিক নারী আন্দোলনের শেষ লক্ষ্য বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে সারা বিশ্বের সর্বহারা শ্রেণীর সঙ্গে সঙ্গে শোষিত নারী সমাজের পূর্ণ মুক্তি।

ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৭